Skip to main content

ভারতকল্প ৪- কালকা, আজকে এবং কালকে!


জানুয়ারী ২৯,২০১৭, শ্যামলী, ঢাকা। দুপুর সাড়ে ৩ টা। অনিশ্চয়তা।
“ধুর ব্যাটা, তুই যদি ট্রেনটাই মিস করলি তাহলে তো বিশাল একটা জিনিস কোনদিন জানলিই না” প্রত্যয় ভাই যখন শ্যামলীতে আমাকে এই কথাগুলো বলছেন তখনো আমার ভিসা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। বিশাল মানসিক অশান্তি চলছে মনের মধ্যে এটা ভেবে যে, জীবনের সবচেয়ে বড় জার্নিতে অন্য সবার সাথে শুরু করার ব্যাপারটা আমার নাও হতে পারে। কোথাকার কোন ট্রেন মিস হয়ে যাবে এই চিন্তা তখন অনেক দূরের ব্যাপার।

ফেব্রুয়ারী ১,২০১৭। হাওড়া। কলকাতা। রাত ৮ টা। দেরী।
অনেক আগে ছোট থাকতে আব্বুর মুখে শুনতাম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশান চালু হবার পর ঢাকার অলিতে গলিতে এক শহুরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুজব হচ্ছে কমলাপুর স্টেশান এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্টেশান। সেই গুজব এর অবসান কীভাবে হয়েছিল আমার জানা নেই। তবে কমলাপুর স্টেশানকে আদতেই বড় স্টেশান ভাবার মধ্যে যে সীমিত জ্ঞানগত ভুল আছে তা আমার ভেঙ্গে গেল এই সন্ধ্যায়। ভারতবর্ষে আগে আসা হলেও হাওড়া স্টেশান আগে দেখার কোন কারণ হয় নি। কলকাতাবাসী অবশ্য দাবী করেনা দেরী। এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্টেশান। তবে সন্দেহাতীতভাবে হাওড়া ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে বিশ্রামাগার। ২৩ প্লাটফর্ম আর ২৬ লাইনের এই মহাযজ্ঞ দিয়ে ১২২ টি আলাদা ট্রেন নিয়ম মেনে যাওয়া আসা করে। আর প্লাটফর্ম বলতে আমরা যে ছোট ছোট লম্বা ছাউনি দেখে অভ্যস্ত এখানে বিষয়টা সেরকম নয়। প্রতিটি প্লাটফর্ম একটা ছোট স্টেশান এর মত। যেন এক একটি নাটকের সেট। অসংখ্য মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে জ্যাকেট এর পকেটে হাত ঢুকিয়ে আনমনা হয়ে সেই নাটক দেখি। নিজেকে slow motion এ রেখে দিয়ে ভাবি এত এত মানুষের জীবন কীভাবে চলছে…


অবশ্য এ ছাড়া কিছু করার নেই। আমাদের বিখ্যাত ট্রেন তার ঐতিহ্য মেনে লেট। তাও যেন তেন লেট নয়। পাক্কা ছয় ঘন্টা লেট! এ সময়ে কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করেছি।

১। হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে স্টেশান এর সামনের দোকান গুলোতে সাম্বার, ইডলি আর দোসার মত কিছু দক্ষিণ ভারতীয় খাবার পাওয়া যায়। সাম্বার আর দোসা মৃত্যু ঠেকাতে খেতে আপত্তি নেই। কিন্তু ইডলি অতীব জঘন্য।
২। হাওড়া ব্রিজ এর গোড়ায় পুজোর ফুল এর দোকান আছে অনেক। সন্ধ্যারাতে বাসী ফুল এর বাজারে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা খুবই অধিভৌতিক।
৩। ভারতবর্ষের অন্তত বাংলাভাষী মানুষের রেলগাড়ির নিরাপত্তা বিষয়ে কোন আস্থা নেই। অন্তত রেল স্টেশান এর বাইরে তালা, শিকল আর চাবির কর্মকারদের ব্যাবসার বিশাল কাটতি তাই বলে।


ফেব্রুয়ারী ২,২০১৭। হাওড়া। কলকাতা। রাত ১ টা ৩০। কু-ডাক।
“ আমার পথচলা, আমার পথে, যেন বেলাশেষে…” খুব অদ্ভুত কারণে সবাই যখন কাহিল হয়ে যায় তানভীর তখন ঘুমায় না। অন্যসময় তার ঘুম নিয়ে সবাই যা মনে চায় তা ভেবে নিতে পারে এবং তানভীর সেটাকে সত্য প্রমাণ করতে ঘুম নিয়ে অদ্ভুত কিছু করেও বসে। হাওড়ার অপেক্ষাগার জুড়ে যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়া বোধহয় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ নাক টেনে দিব্যি ঘুমুচ্ছে। তানভীর গান গেয়ে যাচ্ছে। কারো কারো মুখে কিঞ্চিৎ বিরক্তি আসলেও সবাই আসলে কেমন উদাস। সারাজীবন ঘড়ি ধরে চলতে হয়। সময় মত জমা দিতে হয় আমাদের। নাম্বার গুনে গুনে জীবন চালাতে হয়। ইঞ্চি গুনে ডিজাইন। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় স্বাদ বোধহয় এই ই যে- ছয় ঘন্টার দেরী ট্রেন এর। তাতে আসলে কিছু যায় আসে না। কিছুই না…
হঠাৎ শোরগোল পড়ে গেল। ট্রেন আসছে। ট্রেন আসছে!! বিশাল বিশাল ব্যাগ নিচে রেখে এসেছি। সেগুলোর কাছে পৌছাতে হবে। ট্রেন এ উঠাতে হবে! যেতে হবে দিল্লী! দিল্লী যে বহুদূর!! কুউউউউউউউ!!!! ট্রেন এর ডাক শোন যাচ্ছে। কু-ডাক!


ফেব্রুয়ারী ৩,২০১৭। হাওড়া। কলকাতা। রাত ৩ টা। বোমা?
এ, বি, সি , ডি… যে কম্পার্টমেন্ট এ সিট বরাদ্দ তার নাম্বার H22। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সেই নাম্বার খুজে বেড়াচ্ছি। হাতে ট্রলি, পিঠে ৯০ লিটারের বিশাল ব্যাগ। কিন্তু সব কিছুর চেয়ে অনিশ্চিত ব্যাপার এই ট্রেন এর শেষ কোথায়? এ যেন বিশাল কোন অজগর! তার কোথাও গিজগিজ করছে মানুষ। কোথাও আবার দরজা জানালা একদম ভেতর থেকে আটা! ফার্স্টক্লাস!! এসির ধোয়া ঝাপসা করে রেখেছে জানালা। হাতড়াতে হাতড়াতে পাওয়া গেল অবশেষে বগি।
৬ সিট এর আসন। আমরা মানুষ ও ছয়জন। আমি, সাদিয়া, ইফতি, ইলা, আনিকা, নাইয়ারা। যদিও আমাদের সিট এ একটা ছোট গোলমাল আছে। তবে মনে হয় সেটা মানিয়ে নেয়া যাবে। বিশাল ট্রলিটা সিটের নিচে ঢোকাতে গিয়েই অবশ্য বিপত্তি। কার যেন একটা স্যুটকেস আছে ভেতরে! কিন্তু, ট্রেন তো মাত্রই আসল। স্যুটকেস কার?
-         ও ভাইসাব, ইয়ে স্যুটকেস কিসকা হ্যায়? কার স্যুটকেস এটা?
-         (জবাব নেই)
-         ও ভাইইইই…
-         (ইফতি) আরে কী বিপদ। এটা কার স্যুটকেস? এটাকে রেখে দিব কই এখন?
-         (আমি) পাশের সিটে রেখে দে। নাকি?
-         (ইফতি) পাশের সিটে যদি আরেকজন আসে?
-         (আনিকা) তার চেয়ে বড় কথা এইটাতে আছে কী?
-         (সাদিয়া) রাখ তো সরায়ে। যার হয় সে নিবে
-         (আমি) কিন্তু এইটা যদি হারানো হয়?
-         (ইফতি) যদি বোমা হয়?
-         (ইফতি বাদে বাকি সবাই) বোমা?
-         (ইফতি) হইতেই পারে।
-         (আনিকা) হু পারে। এক কাজ কর। বাইরে রেখে আয়।
-         (আমি) দে, ভাল্লাগেনা এইসব


২০ মিনিট পর আসন গ্রহন করে জাকিয়ে বসার পর এক টমেটোর মত লাল ভদ্রলোকের প্রবেশ। তিনি অগ্নিশর্মা।
-         আরে আমার স্যুটকেস বাইরে কে রেখে আসছে?
-         (আমরা) (জবাব নেই)
-         (অন্য সবাই) জবাব নেই।
-      (ব্যাগওয়ালা ভদ্রলোক সন্দিঘ্ন চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে) আপনারা দেখেছেন কে ব্যাগ বাইরে রেখে এসেছে?
-        (মাথা এদিক ওদিক নাড়া। সবাই একসাথে)
ভদ্রলোক আমাদের উল্টাদিকের সিটে গ্যাজ মেরে বসে পড়লেন। অগ্নিদৃষ্টি আমাদের দিকেই তাক হয়ে আছে। সামনে প্রায় ৩৬ ঘন্টার জার্নি। মনে হচ্ছেনা খুব ভাল যাবে লম্বা সময়টা। আমার সিট মিড বাংকারে। বিছানা মেলাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে ব্যাগ আর বোঝার অত্যাচারে। ব্যাগ গুতিয়ে মাসুদ রানা সিরিজের সস্তা বইটা বের করলাম… Long day and night ahead!


ফেব্রুয়ারী ৩,২০১৭। । নিরসা। সকাল ১১ টা। ভারতবর্ষ।
-         (ইফতি) জিসান। জিসাআআআআআআন। জিসাআআআআআআআন। উঠ ব্যাটা।
-         (আমি) কি হইছে?
-         (ইফতি) আরে উঠ ব্যাটা low cost cosplay আমাদের সামনে।
ফিলিপাইন এর নামকরা কমেডি কসপ্লেয়ার আমাদের হাওড়া থেকে ছেড়ে আসা কলকা এক্সপ্রেস এর নন এসি তৃতীয় শ্রেণীর স্লিপিং বাংকার কোচ এ কী করে? খুব অদ্ভুত এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে আড়মোড়া ভাংলাম। সামনে যাকে নিয়ে ইফতির এত আগ্রহ তার সাথে অবশ্য যার কথা বলা হচ্ছে তার বেশ মিল আছে। আগুন রঙ এ ব্লিচ করা চুল। গায়ে দশাসই লেদারের জ্যাকেট। কানে পিয়ার্স করে রুপালী রঙ এর কাটার দুল পড়া। যদিও এরকম গ্যাংস্টার গেট আপ এর সাথে চেহারায় নিতান্ত নীরিহ একজন মানুষ বসা। আমাকে আধাখোলা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হয় আশ্বস্ত করতেই একটা হাসি দিয়ে হাত নাড়লেন। আমিও মুখ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই বললাম “হ্যালো” । গদাই লস্করি চালে আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে ভারতবর্ষের বুক চিরে। বঙ্গোপসাগরের তীরের বাংলাদেশ থেকে বাংলাভাষী কলকাতা ছুয়ে দিল্লী সালতানাত বহুদূরের পথ।
            বাংলা ভাষাভাষীর পরিমাণ যে আস্তে আস্তে কমে আসছে তা অবশ্য এই ধরনের ট্রেন এ কান পাতলেই শোনা যায়। জনাকীর্ণ ট্রেন এ ফিসফাস বা কথা বার্তা চলছে ২৪ ঘন্টাই। হিন্দীর পাশাপাশি অন্য ভাষার আলাপন কানে আসছে। আর আসামী ভদ্রলোক এর আমার সিটে আমার পায়ের কাছে বসে থাকার হেতুটা হচ্ছে- নামে এক্সপ্রেস ট্রেন হলেও ভারতবর্ষের এই সুবিশাল ভুমি পার হবার সময় কলকা কখনো লোকাল কখনো মেইল কখনো এক্সপ্রেস। এখন অফিসগামী মানুষের ভীড় সামলাতে সে লোকাল। এক দেড় স্টেশান যাবেন এসব মানুষ। তারা কেউ কয়েক স্টেশান বা এক রাজ্য পর গিয়ে কাজ করেন। কত ভাষার, কত বর্ণের, কত ধর্মিবিশ্বাস আর ব্যাক্তিত্বের মানুষ। আর একটু পর পর নাম না জানা স্টেশান! এই জার্নির পরের ৪০ দিন মানালির চুড়ার বরফ থেকে আরব সাগরের পানি, থর মরুভূমির বালি থেকে মুম্বাই এর কসমোপলিটন নিয়ন বাতি কিছুই নজর এড়ায় নি। কিন্তু কলকা এক্সপ্রেস এই ঝাড়খন্ড আর বাংলার মাঝামাঝি কোথাও সম্ভবত ভারতবর্ষ এভাবেই আমাকে দেখা দিয়ে গিয়েছিল নিজের আসল চেহারা নিয়ে।



ফেব্রুয়ারী ৩,২০১৭। । কাড়াই । দুপুর ৩ টা। দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
ট্রেন এ এত দীর্ঘযাত্রায় বাংলাদেশী হিসাবে আমরা আসলে অভ্যস্ত না। আমাদের উপরে সেটার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সব করার মত কাজ একবার করা শেষ। এখন চলছে গভীর চিন্তাভাবনা। তবে সেটাও শেষ হয়ে গেলে সেগুলা বাক নিচ্ছে উৎকট চিন্তায়।
যেমন একটূ আগে তমাল রচনা আর পঙ্কজ আসছিল।
-(তমাল) এই ট্রেন এর নাম কালকা কেন জানিস?
-(আমি) এইটার লাস্ট স্টপেজ এর নাম…
-(তমাল) না এইটা তো ওরা তোকে বলে।
-(রচনা) তাহলে আসল কারণ কী?
-(তমাল) কারণ আমরা আজকে পৌছাব না। পৌছাব…………কালকা (হে হে হে হে)
কিন্তু এর ঘন্টাখানেক পর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম রচনা বসে বসে গানের মত করে সিয়ান এর সাথে বলতেছে, আজকে না কালকা, কালকা, কালকা, কালকা…

একজন বাংলাদেশীর কাছে ভারত খুব বিতর্কিত একটা জায়গা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যকারী দেশ, যাদের পরবর্তী সময়ের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমরা কোনদিন খুশী হতে পারি নি। কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা ভারতকে যেমন জানি, তেমনটা আসলে কেন জানি? খবরের কাগজে আজগুবি সব খবর পড়ে? হ্যা। কিছুটা। আমাদের সাথে চুক্তিগুলোর সমালোচনা করে বা বাবা দাদার কাছ থেকে কলকাতার বাবুদের নিয়ে বৃটিশ অনুপ্রাণিত কৌতুক শুনে। অনেকটা। তবে সবচেয়ে বেশি জানি হিন্দী ছবি দেখে। আমার জন্ম ৯০ এর দশকে। বাংলাদেশে হিন্দী ছবির ক্যাসেট প্রবেশ এর স্বর্ণযুগ। বাবা মা এগুলো দেখার ব্যাপারে কিছুটা রক্ষণশীল হলেও চাচাতো, ফুফাতো ভাই বোনের পিছে পিছে শাহরুখ খান আর কাজল এর কিছু হিন্দী ছবি চোখে না পড়ে তো আর পারে না।
যাহ সিমরান, জি লে আপনি জিন্দেগী… আর সরিষা ক্ষেত এ শাহরুখ খানের দুই হাত মেলে ধরে রাখাটা না দেখলে কি ভারত কেমন ধারণা পূর্ণ হয়?
এই ট্রেন জার্নি অবশ্য উত্তর দিয়ে দিল ওই দৃশ্যায়ন গুলো ওরকমই কেন। এই যে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার এর যাত্রা আর তার মাঝে ৫০ এর মত স্টেশানে ট্রেন দাঁড়ানো, হাওড়া, ভানারাসি আর কানপুর এর মত দুই তিনটা বড় স্টেশান বাদ দিলে যে কোন স্টেশান এর প্লাটফর্ম এ লালচে রঙ এর ফুল, হলুদ রঙ এর বৃটিশ ঘর আর জং ধরা লোহার ছাউনি দেখলে বার বার মনে হতে থাকে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েংগের সেট আজও এক রত্তি বদলায়নি। নাম না জানা কোন স্টেশান থেকে ট্রেন যখন ছেড়ে যায় একটু বেখেয়াল থাকলেই মনে হতে পারে ওই দরজায় চিরতরে চলে যাবার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আর আচল উড়িয়ে কেউ দৌড়ে আসছে তার হাত ধরার জন্য…


ফেব্রুয়ারী ৩,২০১৭। । রানিয়া। সন্ধ্যা ৭ টা। উত্তরের ডাক।
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশ। বাংলাদেশ মৌসুমী জলবায়ুর দেশ। বাংলাদেশ ট্রপিকাল জলবায়ুর অন্তর্গত। মুখস্তের সুরে সন্ধ্যা হলে একসময় এই লাইন গুলি পড়তাম। তখন কেউ বলেনি এই কথাগুলোর মধ্যে একটা ছোট উহ্য ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের জলবায়ুর মূল কারণ বা নিয়ামক হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার অবস্থান। উত্তরের বাতাস থেকে হিমালয় পর্বতমালা আমাদের রক্ষা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। হিমালয় অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক পর্বতমালা। তাই এর উচু নিচু আছে। ভারতের কিছু অংশে সেই নিচু পর্বতের ভ্যালি ধরে সাইবেরিয়া থেকে আসা উত্তরের হিমেল বাতাস চলে আসে বিস্তির্ণ সমতল ধরে। মৌসুমীর সিনেমা দেখা আর মৌসুমী জলবায়ুতে অভ্যস্ত আমরা সেই সাইবেরিয় বাতাসের কামড় খেয়ে অভ্যস্ত নই একদমই। তাই সেই কামড় যখন ট্রেন এর ধাতব কামড়ায় গায়ে কামড় বসাল তা একটা শক এর মত। দিনের আলো শেষ হবার সাথে সাথে একদম জাকিয়ে বসতে শুরু করেছে শীত। আর ট্রেন এর তৃতীয় শ্রেণীর কামরা থোড়াই কেয়ার করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রনের। তাই দেশ থেকে বয়ে আনা শীতের জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে গ্যাট হয়ে বসে থাকা। বই শেষ হয়ে গেছে। পছন্দের গান গুলো গাওয়া শেষ হয়ে গেছে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক লাপাত্তা। এ অবস্থায় শুধু দুশ্চিন্তা। বাংলার বাইরের খাবার হজম হবে তো?


এই খাবারের দুশ্চিন্তা অবশ্য বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় রেলওয়ের প্রাত্যহিক খাদ্য। তাতে রয়েছে
১। ভেজ রাইস (বেশ বাজে ধরনের অখাদ্য)
২। আন্ডা রাইস (অখাদ্য, তবে মানসিকভাবে আঘাত কম দেয়)
অবশ্য আমরা না খেয়ে আছি এমন নয়। ইফতি আর আমি যেহেতু কাছাকাছি সিট এ বসা হকাররা জেনে গেছে যে বার বার যাওয়া আসার ফাকে এখানে থামলে হাভাতের মত সব একটূ করে খাচ্ছে এমন দুইজন বান্দা আছে এখানে। গুলাবজামুন, সামুসা, লেইস চিপ্স থেকে কাচুরি সব মুখে দেয়া শেষ। সাদিয়া জেগে থাকলে যা যা খেতে ভাল লেগেছে তাকে সহ আরেক রাউন্ড খাওয়া। সন্ধ্যা নাগাদ এক রাউন্ড উনো খেলাও হয়ে গেল। এক পর্যায়ে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও আর করার কিছু পাওয়া গেল না। কু ঝিক ঝিক আওয়াজ করে ট্রেন চলছে। ঘর বাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। দরজা বন্ধ অনেক কম্পার্টমেন্ট এর এখন। ভীড় কমে এসেছে। এত মানুষের ট্রেন এ তুলনামূলক নৈশব্দ। কত বাড়ীঘর পার হয়ে যাচ্ছি। কত মাইলস্টোন সাক্ষী হচ্ছে কলকা মেইল এর আরেকটি লেট পুষিয়ে দেবার প্রচেষ্টার। চিন্তাধারায় ছেদ পড়ল কোওওও আওয়াজে। নিজের পেট এর ই ডাক। উত্তরের খাবার ভালভাবে নেয় নি শরীর। ডাক আসছে তাই। উত্তরের ডাক।


ফেব্রুয়ারী ৪,২০১৭। । বৃন্দাবন। সকাল ১১ টা। লাল মাটি।
সাদিয়ার মোবাইল স্ক্রীন এর দিকে ভুরু কুচকে তাকিয়ে আছি। পিউলি আর তমাল এর সাথে কোন একটা বগীর মাঝে দাঁড়ানো। ওরা গেয়ে যাচ্ছে “…বাধা পড়েছে জীবনযে, কতসুখ কল্পনা, কত মিথ্যা প্রলোভন…” অবশ্য আমার কাছে তিনটা জিনিস ই এই মুহুর্তে সত্য। আমার ধারণা-
১। আমার জীবন এই ট্রেন এ বাধা পড়ে গেছে। আমি ফোবিয়া আক্রান্ত।
২। আবার মাটিতে নেমে যাওয়া ও সাধারণ জীবন কাটানো একটা সুখ কল্পনা।
৩। দিল্লী আদৌ পৌছাব এটা একটা মিথ্যা প্রলোভন।
ওহ আর ভুরু কুচকে তাকিয়ে আছি কারণ জায়গাটার নাম বৃন্দাবন। শ্রীকৃষ্ণ এর জীবনী নিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্ক ইন্ডিয়ার ব্যাপক আগ্রহের কারণে নামটা খুবই সুপরিচিত। কিন্তু আমার জানা ছিল না আগ্রা আর দিল্লীর মধ্যে কোন এক জায়গার নাম আসলেই বৃন্দাবন। দিল্লীর গন্ধ অবশ্য মাটিতে আসছে। লাল রঙ এর মাটি। রুক্ষ অগোছালো ভাব আশেপাশে প্রকট হয়ে উঠছে। হকারদের আসার সময় হাকের সাথে বাড়ছে পণ্যের দাম।
ইফতি অবশ্য এসময় ঘুরিয়ে দিল আগ্রহ। কলকা মেইলে ওঠার সময় সাবধান করা ছিল সবাইকে বিখ্যাত হিজড়া এমব্যুশ এর। কলকা মেইল এর এই এমব্যুশ একদম নাম করা। আমি সকাল থেকে ভাবছিলাম “কই এমন তো কিছু হল না।“ তবে ইফতি যেটা জানাল এরকম ঘটনা গতকাল রাতে ঘটেছে একবার। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমরা সবাই হয় ঘুমুচ্ছিলাম না হয় শুয়ে ছিলাম। আর আমার সিট টপ বাংকারে হওয়ায় আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে তারা চলে যায়। যেটা নাক ডেকে ঘুমানোয় আর টের ও পাওয়া হয় নাই।


ফেব্রুয়ারী ৪,২০১৭। । নয়াদিল্লী। দুপুর ২ টা। রাস্তা থামায় দিল।
দিল্লী কেন বহুদূর- ব্যাপারটা প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বুঝলাম একদম হাড়ে হাড়ে। লাল মাটির আভাস, যান্ত্রিক গোলযোগ, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন আর মানুষের বিস্তর শোরগোল আভাস দিচ্ছিল দিল্লী আসছে! কিন্তু আসছে তো আসছেই। এসে তো আর পৌছাই না। প্রতিবার স্টেশান আসে। ব্যাগ এ হাত দেই। আর নতুন একটা করে নাম শুনি।
-         এই পালওয়াল। (কী? পালোয়ান?)
-         এই ফরিদাবাদ। (হুম প্রায় মুঘল মুঘল ভাব।)
-         এই বাদলাপুর। (সিনেমাটিক অনেক।)
-         জাসোলা!
-         নিজামউদ্দিন…
এক সময় রাস্তা আসলেই থামে। ৩৬ ঘন্টা পর কেচোর পেট থেকে পা পড়ে লম্বা প্লাটফর্মে। আমাদের যাত্রা শেষ হলেও আমাদের বয়ে আনা কেচো চলে যাবে আরো বহুদূর। কলকার দিকে। ডাক ছেড়ে আমাদের উগড়ে দিয়ে সে রওনা দিল। আর কী হবে দেখা? মনে হয় না।



 দিল্লীর শীত আর দিল্লীর গরম দুটোই বিশ্রী। দুপুর বেলাটা কেমন যেন বুঝতে পারছেনা সে আসলে আমাদের কোনটা দেখাবে। দেখতে গরম লাগছে শীত টাইপের আবহাওয়াতে ভারতের রাজধানীতে পাড়া। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে।সাদিয়ার সাথে খাবার খুজতে ম্যাকডোনাল্ডস এ আলু টিক্কি বার্গার আর নাঙ্গা মসলার ঝাজ ওয়ালা পেয়াজু টাইপের দেখে খাবার পেটের ক্ষুধাকে মন ভয় এ রুপান্তর করছে। হোটেল খুজতে হবে। ট্যাক্সি ডাকতে হবে। সময় লাগবে এসবে। ততক্ষণ গান চলবে। গান চলছে-
“রাস্তা থামায় দিল, রাস্তা থামায় দিল সিল--সিলা…
ওরে, এলো দিল্লীতে নিযামউদ্দিন আউলিয়া আ আ এলো, দিল্লীতে নিযামউদ্দিন আউলিয়া…”

Comments

Popular posts from this blog

ভারতকল্প ৩.২- ভুতুড়ে স্বাধীনতা (২)

মর্গ থেকে বেড়িয়ে গাড়ির ভেতরে সবাই একটু ঘোরগ্রস্থ। একই নেটওয়ার্কে চারটা মোবাইলের আলাদা জিপিএস আমাদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছে। পিউলির অবশ্য এক্সেলারেটরের পা উঠে যায় নি। গাড়ি চলছেও সেই ঘোরের মধ্যেই। এর মধ্যে জানে পানি আসার মত জিপিএস ঠিকমত লোকেট করে ফেলল সবাইকে। রেডিও সিগনাল ও ফেরত এসেছে। মর্গ এর ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে করতে জায়গামত এসে পৌছে গেলাম আমরা। এই সেই জাপানী ভদ্রলোকের বাগান। দেখে মনে হয় ইঞ্চি ইঞ্চি করে তৈরি করা। অথচ প্রকৃতি থেকেও আলাদা হয়ে যায় নি। আর ওই দূরে ভারত মহাসাগরের কাচের মত নীলাঞ্জনা হীরার মত পানি! এক চিলতে সাগরপাড় দেখা যাচ্ছে। বহু বহু নিচে! সেখানে কষ্টিপাথরের মত শৈবাল থেকে আসা কাল পাথর জমাট বেধে আছে কিছু। এই দেখতেই না এতদূর এত পথ ঘুরে আসা! সাগরপাড়ে নেমে যাওয়ার সেই ভয়াল রাস্তা!  নিচে নামার ব্যাপারটা অবশ্য নিজেই একটা আলাদা জার্নি। আড়াই ফিট চওড়া সিড়ি আছে একটা। তাঁর কোন রেলিং নেই। ঘুরে প্যাচ খেয়ে নেমে গেছে সৈকতে ঠিকই। তবে তাঁর পরতে পরতে আবার ছোট ছোট এডভেঞ্চার! কোথাও পাথর কেটে দরজা তৈরি করে চলে গেছে সিড়ি, তো কোথাও সিড়ির দুইপাশে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছের ছা...

ভারতকল্প-১- রাজধানী এক্সপ্রেসঃ নিজামউদ্দিনের শহর!

“রাস্তা থামায় দিল, রাস্তা থামায় দিল আউলিয়া... এল দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া এলো...” চন্ডিগড়ের রাস্তা থেকে দিল্লীর বুকে যখন পা রেখেছি তখন আড়াইটার ঘর পার হয়ে মিনিট এর কাঁটা রাত তিনটার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বাসে চলতে থাকা বাংলা গান এর লাইনগুলো মাথার মধ্যে কেন বেজে চলেছে তার কারণ ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মানসিকভাবে একটু বিরক্ত লাগছে কারন এই দুই লাইনের পরের দুই লাইন ঘুমে জড়সড় চোখ নিয়ে মনে আসতে চাইছে না । কেমন একটা ঘোরলাগা অবস্থা। দিল্লীর পাহাড়গঞ্জ এর আরাকাশান রোড এর হোটেলগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুমায় না তাঁদের গায়ে লেগে থাকা নিয়ন বাতিগুলো। ঘোরলাগা- মন মানসিকতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সেগুলোর চোখে পীড়া দেয়া লাল, নীল সবুজ রঙ। আধাঘন্টার মধ্যে কীভাবে হোটেল এ ৪৪ জন মানুষের চেক ইন, লাগেজ রুমে রুমে পৌছে দেয়া হয়ে গেল টের ও পেলাম না। রুম শেয়ার এর চার্ট আগে থেকেই করা থাকায় কিছুক্ষণ পরেই মাঘ মাসের ত্রাহি ত্রাহি শীতের মধ্যে কম্বলের আরাম এ তলিয়ে গেলাম। আগামীকাল দিল্লী অভিযানে বের হওয়া হবে হয়তো। সকালে উঠে একটা প্ল্যান করতে হবে। অনেক নাকি দেখার জায়গা। এসব বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনাতে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ...

ভারতকল্প ৩.১- ভুতুড়ে স্বাধীনতা!

চন্ডীগড় শহরে স্থাপত্য দেখার ব্যাপারটা প্রায় কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনের ছকের মধ্যে আরেক কর্তব্য ছিল সেখানকার আর্কিটেকচার স্কুল ঘুরে দেখা। এই দেখার ফাকে একজন শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন- “এই যে ৪০-৪২ দিনের ভারত দেখে বেড়ানোর বিশাল আয়োজন, এর মধ্যে কোন শহরে কতদিন বরাদ্দ?” ৪০ দিনের বাধা ছকে গোয়া’র জন্য বরাদ্দ পাঁচদিন শুনেই মুখ টিপে হেসেছিলেন অনেকে। গোয়া যেন ভারত মহাসাগরের তীরে স্বাধীনতার ডাক (ছবিঃ সেহরান পারভেজ সিয়ান) আমরা ভারতবর্ষে প্রথম ঘুরতে আসা স্থাপত্য ব্যাচ নই। এই ঐতিহ্য ঠিক কতদিনের পুরাতন তা নিয়ে বেশ একটা ধোয়াশা আছে। তবে বছরের হিসাবে ৩০ এর কম তো নয় ই। এমনকি আমাদের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক ও তার ভারতভ্রমণ এর রেফারেন্স টানেন ঐতিহাসিক স্থাপত্য পড়াতে। গোয়া শহর নিয়ে শুধু চন্ডীগড়ের শিক্ষকেরা নন শুধু আমাদের নিজেদের মধ্যেও বাড়তি উত্তেজনা স্পষ্ট। গোয়া হচ্ছে- স্বাধীনতার নগর! মুম্বাই এর মত কসমোপলিটান নয়, কক্সবাজারের মত বিশ্বের বৃহত্তম সৈকত ও নয়, গোয়া শহর এর স্বাধীনতা একটা সাগরকণ্যা ছোট শহরে দাঁড়িয়ে সাগরপাড়ের জীবনের সর্বোচ্চ স্বাধীনতার হাতছানি! কী না কী হবে সামনে! কত কত গল্প শুনে যাচ্ছি, তা...