অনবরত স্কেচবুকের পাতায় মসৃন পাশে
পেন্সিল ঘষে যাচ্ছি। কাজটায় কেমন একটা অতৃপ্তি আছে। পেন্সিল চলার কথা কাগজের অমসৃণ
পাশে। সামনে “বেংগল আর্কিটেকচার” এর ক্লাস চলছে। প্রফেসর অনেক আগ্রহ নিয়ে বলে
যাচ্ছেন কিছু একটা। মনোযোগ নেই আমার তেমন। আমি ভয়াবহভাবে অন্যমনষ্ক। অন্যমনষ্কতার
মধ্যে অন্যমনষ্কতা বলে কোন ব্যাপার আছে কীনা জানি না বা মূহুর্তকালের জন্য মনোযোগ
ফেরত আসার মত একটা সময়ে কয়েকটা কথা কানে ঢুকে গেল-
“বুড়িগঙ্গা নদীতে শুধু
বিলাস জাহাজ নয়, বাণিজ্যিক জাহাজ ও ঢুকত সে সময়ে। জাহাজিরা মুগ্ধ হয়ে যেত চারটি
আলাদা ঘাটসহ বাড়িটার চেহারা দেখে। আর্মেনিয়ান, বৃটিশ আর ঢাকার ক্লাসিক চেহারা
মিলিয়ে সে বাড়ি আসলেই ছিল দেখার মত। ক্লাসিক আর্কিটেকচার পড়িস? মুগ্ধতা আসে গোথিক
বা রোমান বিল্ডিং এর চেহারা দেখে? চিন্তা করে দেখ ওই সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানরা মুগ্ধ
হত এই বাড়ি দেখে। কিন্তু তোরা যেন কেমন। কোন কিছুতেই অবাক হস না।“
কোন সে বাড়ি যেটা
বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে দেখা যায়? আমার পাশে পুরাতন ঢাকার ইফতি বসে আছে। ওকে
পেন্সিলের মাথা দিয়ে হালকা গুতা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-
-এটা কই রে?
-ফরাসগঞ্জে। শ্যামবাজারের দিকে।
-অনেক বড় বাড়ি নাকি?
-মাত্রই তো বলল ক্লাসেই। শুনলি না?
-চল একদিন দেখে আসি।
-যাওয়া যায়। কিন্তু ক্যামেরা নিতে পারবি না আর জামাকাপড় এ একটু কেয়ার নিতে হবে।
-জামাকাপড়ে কেয়ার নিতে হবে কেন?
-পুরাতন টি শার্ট পড়ে চলে আসিস। গেলে বুঝবি কেন। আর আবারো, মোবাইল ছাড়া ক্যামেরা আনিস না।
-ফরাসগঞ্জে। শ্যামবাজারের দিকে।
-অনেক বড় বাড়ি নাকি?
-মাত্রই তো বলল ক্লাসেই। শুনলি না?
-চল একদিন দেখে আসি।
-যাওয়া যায়। কিন্তু ক্যামেরা নিতে পারবি না আর জামাকাপড় এ একটু কেয়ার নিতে হবে।
-জামাকাপড়ে কেয়ার নিতে হবে কেন?
-পুরাতন টি শার্ট পড়ে চলে আসিস। গেলে বুঝবি কেন। আর আবারো, মোবাইল ছাড়া ক্যামেরা আনিস না।
মাথা ঝাকিয়ে রাজি তো হলাম। তবে সাথে এবার সত্যি সত্যিই অবাক ও হলাম। ক্লাসের কথা আরেকটু শোনা দরকার ছিল। ভাবতে ভাবতে মনে হল ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা উচিত। তবে পরে মন পরিবর্তন করলাম। এর জন্য আসলে একটা দুইটা বই ঘাটা উচিত আগে।
পুরান ঢাকা বলে আজ যে জায়গাটা নিয়ে আমাদের নতুন
ঢাকাবাসীর এত এত আগ্রহ, একসময় সেটাই ছিল পুরো ঢাকা। বুড়িগঙ্গার পাড়ের তিলোত্তমা
নগরী, মধুপুর ট্র্যাক এর মাটি যেখানে এসে মিশেছে বুড়িগঙ্গার পানি থেকে পাওয়া জীবন
শক্তির সাথে। বাংলার স্বাধীনতা পদানত হয়নি মুঘলদের কাছে অনেকদিন। যখন মুঘল
সুবাদারেরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন এই শহরের বুকে তখনও কার্যত তাঁরা
ছিলেন স্বাধীন ই। কিন্তু বৃটিশরা এসে যেন পুরো ইতিহাসটাই উল্টে লিখতে চাইল। কাগজে
কলমে স্বাধীন বাংলা থেকেই শুরু হল তাঁদের ভারত জয়। বৃটিশ ভারতে বাংলা এবং এখনকার
বাংলাদেশ সব সময়েই তাই ছিল গুরুত্বপূর্ন অংশ। কলকাতা বৃটিশ ভারতের প্রাথমিক
রাজধানী ছিল অনেকদিন। এই সময়টাতে ঢাকা কিছুটা অবহেলিতই ছিল। তবে ধীরে ধীরে বৃটিশ
শাসনের দ্বিতীয় শতকে মুসলমান সমাজ এ “এলিট” শ্রেণির প্রভাব বাড়তে থাকায় ঢাকার
গুরুত্ব বাড়ে। ঢাকার হিন্দুসমাজও কলকাতার ধনিক শ্রেনীর সাথে পাল্লা দেয়ার মত প্রভাব
প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন এ সময়টাতেই। তাঁদের নিজেদের মধ্যে আবার তৈরি হয় একটা
প্রতিযোগিতার মনোভাব। বৃটিশদের সর্বগ্রাসী বাণিজ্যনীতি আর কলোনিয়াল শাসন প্রকৃতির
কারণে অন্যান্য বিদেশী বণিকেরা ঢাকা ছেড়ে যেতে থাকে। বিক্রি হতে থাকে তাঁদের
স্থাবর সম্পত্তি, রয়ে যায় সেসবের স্থাপত্যরীতি আর এর সাথে যোগ হয় বৃটিশ ও দেশি
স্থাপনার সেসময়ের “trend”. ঢাকার প্রায় এক
শতকের বিখ্যাত ভবনগুলোতে এখনো রয়েছে সেই ছাপ।
এই সময়কালে ঢাকার দুই বিখ্যাত ব্যাবসায়ী ছিলেন
রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। ঢাকার বণিক সমাজে বেশ নামডাক হয়েছিল দুজনের ই। ১৮৩৫
সালের দিকে তারা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের সামাজিক মর্যাদার সাথে মানানসই একটা বাড়ি
কেনা দরকার তাঁদের। তাঁরা বেছে নিলেন সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে বড় বাড়িগুলোর একটিকে।
আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন ১৮২৫ সালের কাছাকাছি সময়ে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ১০ বছর
বয়সী বাড়িটি রূপলাল কিনে নেন নগদ টাকায়। রূপলাল ব্যাবসায়ী হিসাবে ধনাঢ্য ছিলেন।
তবে প্রায় সব উৎসেই রয়েছে তাঁর ব্যাবসার উন্নতির পেছনে মেধা, পরিশ্রম ও রুচির
প্রশংসা। বাড়ির ব্যাপারেও শুধু বাড়ি কিনেই খুশী হন নি তিনি। নিজের পছন্দ, চাহিদা ও
রুচির সমন্বয়ে পুণঃনির্মান করেন বাড়িটি। এভাবেই রুপলাল হাউজ হয়ে ওঠে ঢাকার বিলাসী
ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীর জৌলুসে ভরা বাসভবন।
ইতিহাসের পাঠ শেষ হতে হতে
ক্লাস স্টুডিওর চাপ এসে দাঁড়ায় সামনে। রূপলাল হাউজ এর প্রতি ঝোঁক এর বশে যে
আগ্রহটা এসেছিল সেটা চাপা পড়ে যায়। তবে একদিন সকালে ঠিকই যাত্রা শুরু করি ফরাশগঞ্জ
এর দিকে। ঢাকা জুড়ে হচ্ছে ছবিমেলা। পুরাতন ঢাকাতেও চলছে দুটো আলাদা প্রদর্শনী। এর
একটা বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছে। ইফতি আফসোস করে বলছিল যে ঢাকা শহর চাইলেই একটা
গোছানো রিভারফ্রন্ট পেতে পারত। বুড়িগঙ্গার কালো পানির দিকে তাকিয়ে একবার আর উপকূল
জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বেগুনি কেমিকেল এর দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি যে কোন
স্থাপত্য শিক্ষার্থীর মত। মাঝি আমাদের আগ্রহ দেখে বুঝাতে থাকে বুড়িগঙ্গা কীভাবে
পানির প্রবাহ স্থবির হয়ে যাওয়া এক হতভাগ্য খাল হয়ে গেছে। মরে যাচ্ছে এই শহর। এসব
ভাবতে ভাবতে চোখে আসে একটা ভাঙা ঘাট। বিচিত্র মানুষের আনাগোনা সেখানে। কিন্তু
বিশাল ধরনের একটা ভবনের মাথা উঁকি দিচ্ছে আরেকটু পেছনেই!
-আচ্ছা, ওইটা কি রূপলাল
হাউজ?
-হু, চিনতে পারছিস তাহলে?
-চিনতে পারিনাই। আন্দাজ করলাম আর কি। আচ্ছা, কতটা লম্বা রে? অনেক বড় তো দেখি।
-নদীর ধারে তো প্রায় ৪০০ ফিট ধরে দেখা যায়।
-বলিস কি!
-হু, চিনতে পারছিস তাহলে?
-চিনতে পারিনাই। আন্দাজ করলাম আর কি। আচ্ছা, কতটা লম্বা রে? অনেক বড় তো দেখি।
-নদীর ধারে তো প্রায় ৪০০ ফিট ধরে দেখা যায়।
-বলিস কি!
![]() |
বুড়িগঙ্গার পাড়ের রুপলাল হাউজ (২০১১) (ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Urban study group ও জয়ব্রত সরকার) |
![]() |
রূপলাল হাউজের অন্দরমহল (২০১৯)(ছবিঃ লেখক) |
রূপলাল হাউজ আসলেই অবাক করে। অবাক না হওয়া প্রজন্মকে আরো বেশি করে
অবাক করে। গুগল ঘেটে যা পাই সেই তথ্য যথেষ্ট মনে হয় না বলে আরো অবাক করে। রূপলাল
নিজেও অবাক করেন অনেকবার। ছাত্র হিসাবে মেধাবি ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায়
পেয়েছিলেন মেধাক্রমের জন্য ১০ টাকার বৃত্তি। ব্যাবসাজীবন শুরু করেছিলেন লগ্নি
ব্যাবসা করে। তাও একদম পথে পাটের তৈরি বস্তা বিছিয়ে হকার এর মত। সেখান থেকে মেধার
জোরেই উঠে যান ঢাকা শহরের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীর কাতারে। আর মানুষ হিসাবে ছিলেন
ভয়াবহ বিলাসী। এই বাড়ি পুনঃনির্মান এর কাজ তিনি দেন কলকাতার বিখ্যাত ব্রিটিশ
ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মার্টিং এন্ড কোং এর হাতে। বিশাল নির্মানযজ্ঞে ব্যাবহার করা
হয় স্থানীয়ভাবে পোড়ানো ইট আর প্রচুর লোহা। নির্মান কাজ চলেছিল দীর্ঘসময়। বিলাসী
রূপলাল দশক পরিবর্তনের সাথে সাথে শুধু উপমহাদেশের বৃটিশ ভাবধারাই নয় বরং ইউরোপিয়ান
স্থাপত্য হালচাল এর সর্বশেষ সব স্টাইল একটু একটু করে জুড়ে দিয়েছেন তার শখের
বাড়িতে।
তাই বাড়ির প্রবেশপথে আর্মেনিয়ান ধাঁচের প্রবেশপথের বিশাল
কলামগুলোতে দেখা যায় ক্লাসিক কোরিন্থিয়ান স্টাইল এর কলাম। সেগুলো আবার প্রতিটিই
বিশাল । আর ভবনের এক অংশ থেকে আরেক অংশে যেতে টানা দেয়া ঝুলবারান্দার ছাদে তাকালে
দেখা যায় লোহা দিয়ে বানানো বিম এর সাপোর্ট।
কিন্তু স্থাপত্যের এসব তত্বকথার ঝোক একটু হলেও কেটে যায় যখন চোখে পড়ে ছাদ
আর মেঝেতে করা অসাধারণ কারুকাজ। স্থাপত্যের কোন ভাবধারায় এটা পড়ে তার চেয়ে বেশি
মনে আসে একজন বিলাসী ব্যাবসায়ীর মনের রোমান্টিকতা। কত সাধে কত যত্নে গড়ে তুলেছিলেন
নিজের স্বপ্নের বাড়ি।
![]() |
রূপলাল হাউজের বর্তমান প্রবেশপথ (২০১৯) (ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সাজিদ আল কবির) |
ইফতির দিকে তাকিয়ে দেখলাম
সেও আমার মত কিছুটা ভাবের জগতে চলে গেছে। তাই সেটা না ভাঙ্গিয়ে কল্পনা করতে শুরু
করলাম রূপলাল দাস কী কী ভাবতেন তার বিখ্যাত জলসাঘরে দাঁড়িয়ে কিংবা সুস্থ বুড়িগঙ্গা
নদী থেকে ভেসে আসা বাতাস কি পরিবেশ উপহার দিয়ে যেত এই বাড়ির বাসিন্দাদের? কেউ কি
এই বিস্তীর্ন ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়াত? এই বাড়িতে থাকা অগণিত কাঠের বা পাকা
সিড়িগুলো বেয়ে উঠতে উঠতে কি ঝংকার দিত কারো চুড়ির শব্দ? রূপলাল কিন্তু চেষ্টার
কমতি রাখেন নি কোনভাবেই।
রূপলালের বিখ্যাত জলসাঘর ছিল বুড়িগঙ্গার দিকে মুখ করা। ভবনের
পশ্চিম দিকের এই কক্ষে কাঠের সুক্ষ কাজ ছিল সিলিং এ। নিজেকে রূপলাল ভাবতে ভাবতে
ফিরে যেতে ইচ্ছা করল উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে। দক্ষিন এশিয়ার সেরা সংগীত ও
নৃত্যশিল্পীরা আসতেন তাঁর জলসাঘরে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালিউল্লাহ খান
বা লক্ষীদেবীদের সুরে-তালে, শান শওকতে ভরে থাকত এই জলসাঘর। উপর থেকে দেখলে ভবন এর
আকৃতি ইংরেজি বর্ণ E এর মত। নদীর
তীর জুড়ে রয়েছে সবচেয়ে বড় অংশ। আর শহরের দিকে মুখ করে ছড়িয়ে গেছে তিনটি আলাদা উইং।
এর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা উইং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ মিটার (৬০ফিট) এর মত। ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অংশে
সুবিন্যস্ত ছিল বাড়ির কামরা গুলো। ছিল দুটি প্রশস্ত পাকা করা উঠান। আর ছিল বাড়ির
তিনদিকে বিস্তীর্ণ জায়গা। ঢালাই করা লোহার প্রাচীরে ঘেরা ছিল নিরাপত্তা ব্যাবস্থা।
ঢালাই লোহার নকশা ছিল প্রতিটি রেলিং, সিড়ি ও জানালার ফ্রেম এও। পুরো বাড়িজুড়ে
দক্ষিন আর উত্তর পার্শ্বে বাতাস টেনে আনতে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। দূর থেকে দেখা
যেত ফ্রেঞ্চ ক্লাসিকার স্টাইল এর রঙিন কাচে মোড়ানো জানালার ফ্রেম এর কারুকাজ ও।
![]() |
রূপলাল হাউজের ছাদ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় (২০১৯) (ছবিঃ লেখক) |
ইফতি হঠাত করে বলে উঠল,
-তুই কি জানিস ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়াল এর সাথে এই বাড়ির একটা মিল আছে?
-কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল?
-হ্যা। ক্লাসে বলেছিলেন স্যার। তুই আকাশ বাতাস দেখতে ব্যাস্ত ছিলি।
-কী ধরনের মিল? দুইটাই নিও ক্লাসিকাল আর্কিটেকচার?
-নিও ক্লাসিকাল কী না সেটা আমি আসলে জানি না। তবে এই দুই বাড়িতেই ইংল্যান্ডের রানীর অতিথি হিসাবে থাকার কথা ছিল।
-ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তো বানানোই হয় সেইজন্য...
-ঢাকায় আসলে নতুন করে কিছু বানানো হয় নি। ঢাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ছিল বলা যায় দু’টি। একটা ঢাকার নবাব পরিবারের আহসান মঞ্জিল। যেটা সবাই চেনে। আরেকটা হচ্ছে রূপলাল হাউজ।
- দুটো বাড়িতে রানী কীভাবে থাকতেন?
-দু’টো বাড়িতে তো থাকতে পারবেন না। তাই ভোটাভুটি হয়েছিল। কিছু বৃটিশ সাহেব সরেজমিনে দুটো বাড়িই দেখে গিয়েছিলেন। রূপলাল এর বিলাসবহুল জীবন দেখে বৃটিশ সাহেবেরা থ মেরে গিয়েছিল পুরোপুরি। বিপুল ভোটে জিতে যায় রূপলাল হাউজ।
-কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল?
-হ্যা। ক্লাসে বলেছিলেন স্যার। তুই আকাশ বাতাস দেখতে ব্যাস্ত ছিলি।
-কী ধরনের মিল? দুইটাই নিও ক্লাসিকাল আর্কিটেকচার?
-নিও ক্লাসিকাল কী না সেটা আমি আসলে জানি না। তবে এই দুই বাড়িতেই ইংল্যান্ডের রানীর অতিথি হিসাবে থাকার কথা ছিল।
-ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তো বানানোই হয় সেইজন্য...
-ঢাকায় আসলে নতুন করে কিছু বানানো হয় নি। ঢাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ছিল বলা যায় দু’টি। একটা ঢাকার নবাব পরিবারের আহসান মঞ্জিল। যেটা সবাই চেনে। আরেকটা হচ্ছে রূপলাল হাউজ।
- দুটো বাড়িতে রানী কীভাবে থাকতেন?
-দু’টো বাড়িতে তো থাকতে পারবেন না। তাই ভোটাভুটি হয়েছিল। কিছু বৃটিশ সাহেব সরেজমিনে দুটো বাড়িই দেখে গিয়েছিলেন। রূপলাল এর বিলাসবহুল জীবন দেখে বৃটিশ সাহেবেরা থ মেরে গিয়েছিল পুরোপুরি। বিপুল ভোটে জিতে যায় রূপলাল হাউজ।
১৮৮৮ সালে লর্ড ডফরিন আসেন
ঢাকায়। তিনি ছিলেন সে সময় ভারতের ভাইসরয়। রূপলাল হাউজ এ এসময় তাঁর সম্মানে একটি বল
নাচের আয়োজন করা হয়। ডফরিন সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন রূপলাল এর বাড়ী এবং অনুষ্ঠান এর
মান এ। তবে রানী শেষ পর্যন্ত আর উপমহাদেশেই আসেন নি সে সময়ে। তাই ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়াল এর মত রূপলাল হাউজ এও তাঁর পা পড়েনি। রূপলাল হাউজ এর অপ্রাপ্তির তালিকায়
অবশ্য “শেষ পর্যন্ত রানী আসেন নি” ব্যাপারটাকে রাখতে আমি রাজি নই। তবে রূপলাল হাউজ
এর দুঃখের গল্পটাও শুরু এর কাছাকাছি সময়েই। ১৮৯৭ সালে ঢাকায় বেশ বড় ধরনের একটা
ভূমিকম্প হয়। নদীর তীরের নরম মাটিতে তৈরি পাকা ভবনে বেশ খারাপভাবে আঘাত করে এই
দূর্যোগ। রূপলাল আবারো প্রচুর খরচ করে বাড়ির মেরামতির কাজ করেন। কিন্তু কিছু
অপ্রাপ্তি রয়ে যায়। নদীর দিকে সম্মুখভাগে “আরবান স্কেল” এর একটি ঘড়ি ছিল। অনেকেই
দাবী করেন এটি লন্ডন এর বিগ বেন থেকে অনুপ্রানিত ছিল। তবে সে কথার তেমন শক্ত
ভিত্তি পাওয়া যায় না। ভুমিকম্প মেরামতির পর এই ঘড়িটি আর পুনঃস্থাপন করা হয়নি। দাস
পরিবার এর সাথে নবাবদের একটা প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতা ছিল সব সময়ই। কিন্তু মুঘল বা
বৃটিশ ঢাকায় ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাস প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু বৃটিশ শাসন এর
শেষভাগে ধর্ম হয়ে উঠছিল নতুন ঢাকাই সমাজ এর নিয়ামক। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আমরা এখন
পালন করি বাংলার স্বাধীনতার একটি ধাপ হিসাবে। রূপলাল এর মত সম্ভ্রান্ত হিন্দু
পরিবারের অধিপতির জন্য ধর্মভিত্তিক দেশভাগের ধারণাটিই ছিল আতংকের। অনেকের মতে এই
ঘটনায় সাধারণ মানুষ এমনকি মুসলমান এলিটিস্টদের মনোভাবও রূপলালকে পরিবার পরিজন সহ
ঢাকা থেকে চলে যাবার ব্যাপারে চিন্তা করাতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় দাস
পরিবার আর যেন সাহস ই পেলেন না ঢাকা শহরে থাকবার। বাড়ী বিক্রি করে চলে গেলেন
সীমানা পেরিয়ে। দেশভাগের আর দশটি বিয়োগান্তক সম্পর্কের মত শেষ হয়ে গেল দাস
পরিবারের সাথে অভিজাত ঢাকার স্মৃতি। বাড়ির মালিকানা নিয়ে দলাদলির শুরু তখন থেকেই।
তবে ১৯৫৮ সালে মোহাম্মদ সিদ্দিক জামাল রূপলাল হাউজ কিনে নেন। নাম দেন “জামাল
হাউজ”। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির শরীরে এখনো এই নামটিই রয়েছে।
![]() |
রূপলাল হাউজ এর উঠান ও টানাবারান্দা (২০১৯)(ছবিঃ লেখক) |
ফেরার সময় ইফতি বলল- আমি
শুনেছি পুরাতন সময়ে বিদেশীরা ঢাকায় আসলে ফাইভ স্টার হোটেল তো ছিল না, এখান থেকেই
ঘর ভাড়া করত। পরে কিছু লিখিত উৎসের তথ্যে জানতে পেরেছিলাম ডফরিন এর ঢাকা সফরের সময়
যে বলনাচ হয়েছিল সেটা আসলে রূপলাল এর আয়োজন করা ঠিকই, তবে বলরুম বৃটিশদের তরফ থেকে
ভাড়া করা হয়েছিল। আর রূপলাল হাউজে সে সময় থাকার ভাড়া ছিল ২০০ টাকা।
ঢাকা শহরকে কটাক্ষ করে
আমাদের অনেকে ডাকে কংক্রিট এর বস্তি। কংক্রিট এর বস্তি ছুয়ে ফেলেছে পুরাতন ঢাকার
অভিজাত শ্রেণির শেষ নিদর্শনগুলোতেও। রূপলাল হাউজ এর গায়ে বাসা বেঁধেছে বটবৃক্ষ।
তাতে পাখিরা কিচিরমিচির ও করে। কিন্তু তাঁর চেয়ে বড় পরজীবি হিসাবে বাসা বেঁধেছি
আমরা। আশেপাশে প্রত্বতত্ন আইন
![]() |
দখলদারের সীমানা শেষ হয়নি ভবনের ভেতরেও (২০১৯) (ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সাজিদ আল কবীর) |
![]() |
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ ভবন মেরামতে রূপলাল দাস এর তৈরি ঢালাই লোহার সাপোর্ট এ ঝুলবারান্দা
(২০১৯) (ছবিঃ লেখক)
|
আর পূরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন
নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতেই যেন ভবনের গায়ে আশেপাশের ভবনমালিকেরা তুলে দিয়েছেন
নিজেদের ভবন। অনেকে শুরু করেছেন মসলা আর সবজির ব্যাবসা। অনেকে ভাড়ায় এক দুই ঘর
নিয়ে থাকছেন ও দিব্যি দোতলায়। ইফতি কীভাবে যেন কারো সাথে কথা না বলেই পুরা বাড়ি
ঘুরিয়ে ফেলল আমাকে। ঢুকতে বের হতে কোন সমস্যা না হওয়ায় আমি ইফতিকে এবার জিজ্ঞাসা
করলাম-
-আচ্ছা তুই আমাকে ক্যামেরা
আনতে দিলিনা কেন?
-টিশার্ট পুরাতন পড়ে আসতে বলছিলাম মনে আছে?
-হ্যা তা আছে। এসেছি তো সেরকমই।
-সেইজন্যেই তোকে কেউ সাংবাদিক, গবেষক বা সিটি কর্পোরেশান এর লোক মনে করেনি।
-মনে করলে?
-টিশার্ট পুরাতন পড়ে আসতে বলছিলাম মনে আছে?
-হ্যা তা আছে। এসেছি তো সেরকমই।
-সেইজন্যেই তোকে কেউ সাংবাদিক, গবেষক বা সিটি কর্পোরেশান এর লোক মনে করেনি।
-মনে করলে?
ইফতি কিছু না বলে মুচকি
হাসল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বুড়িগঙ্গার গন্ধটা আবারো নাকে ধাক্কা দিল বের হয়ে আসতেই।
ফরাশগঞ্জ জায়গাটা কেমন পুরাতন ঢাকার ঘ্রাণ বয়ে বেড়ায়। সেখানে এই পচা বিদঘুটে
গন্ধটা বেশ বেমানান লাগে। রূপলাল দাস এর
জলসাঘর এর পাশে মসলার দোকানটাও বেমানান লাগে। বেমানান লাগে পুরাতন ঢাকার লাল ইটে
রাস্তায় নতুন বসানো সাদা রঙ এর তীব্র বাতির আলোও। তাঁর আশেপাশে উড়ে চলা পোকামাকড়
অবশ্য ব্যাপারটা ধরতে পারেনা। ওরা কি অবাক হয় বাতির তীব্রতায় বা মানুষের পরিবর্তন
দেখে? ওরা কি দেখে? আমরা কিন্তু সব দেখি। অবাক হই। স্যার ভুল বলেছিলেন ক্লাস এ।
আমরা অবাক হতে ভুলে যাই নি।
(ফুটনোটঃ মসলার দোকানীদের কবল থেকে প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর রূপলাল হাউজকে উদ্ধার করেছে বলে পড়েছিলাম অল্প কিছুদিন আগে।তবে নিজের চোখে আবার দেখতে গিয়ে সেটার কোন সত্যতা অবশ্য চোখে পড়েনি। এখনো বাড়িতে ঢুকতে হয় লুকিয়ে, ক্যামেরা বের করলে মসলা ব্যাবসায়ী ও দখলদারেরা তেড়ে আসেন। আর বাড়ির মেইন ফ্রেম গুলো দখলদার স্থাপনার কারণে মূল রাস্তা থেকে চোখে পড়েনা। বাড়িটির আয়ু ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। খুব ইচ্ছা ছিল রূপলালের জলসাঘরের একটা ছবি তোলার। ময়লার স্তুপ এর ভিতরে গিয়ে সেই ইচ্ছা পূরণ করা আর হয়ে ওঠেনি।)
This feature was published in travel website: Walk Bangladesh @ 20th July 2019
The link of the feature is:
https://www.walkbangladesh.com/ruplal-house/
(ফুটনোটঃ মসলার দোকানীদের কবল থেকে প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর রূপলাল হাউজকে উদ্ধার করেছে বলে পড়েছিলাম অল্প কিছুদিন আগে।তবে নিজের চোখে আবার দেখতে গিয়ে সেটার কোন সত্যতা অবশ্য চোখে পড়েনি। এখনো বাড়িতে ঢুকতে হয় লুকিয়ে, ক্যামেরা বের করলে মসলা ব্যাবসায়ী ও দখলদারেরা তেড়ে আসেন। আর বাড়ির মেইন ফ্রেম গুলো দখলদার স্থাপনার কারণে মূল রাস্তা থেকে চোখে পড়েনা। বাড়িটির আয়ু ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। খুব ইচ্ছা ছিল রূপলালের জলসাঘরের একটা ছবি তোলার। ময়লার স্তুপ এর ভিতরে গিয়ে সেই ইচ্ছা পূরণ করা আর হয়ে ওঠেনি।)
This feature was published in travel website: Walk Bangladesh @ 20th July 2019
The link of the feature is:
https://www.walkbangladesh.com/ruplal-house/
Comments
Post a Comment