ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষের দৈনন্দিন খানাপিনার একটা জায়গা আছে। বকশীবাজার। রোগীর স্বজনের শংকা, ছাত্র-ছাত্রীদের কলরব, জীবনের আশা, খাবারের ঘ্রাণ আর কংক্রিটের জঞ্জাল এর শহরে উঠে যাওয়া ফ্লাইওভার- বকশীবাজার সরগরম থাকে প্রায় ২৪ টা ঘন্টাই। আমার কাছে বকশীবাজার অবশ্য একটা অলিখিত সীমান্ত। পুরাতন আর নতুন ঢাকার সীমান্ত। একসময় আধুনিক নগর পরিকল্পনার সাথে তাল রাখতেই শহরের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় আর সার্ভে স্কুল করেছিল বৃটিশ সরকার। কিন্তু ঢাকার বেড়ে ওঠার অস্বাভাবিক গতি বকশীবাজারকে বানিয়ে দিয়েছে ঢাকার নিতান্ত সাধারণ একটি মোড়। তবে ঢাকা শহর কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো বকশীবাজার পার হয়ে চকবাজারের দিকে একরকম আর পলাশী হয়ে নিউমার্কেট এর দিকে গেলে আরেক রকম। এটাই পুরাতন ঢাকা আর নতুন ঢাকা। এটাই ঐতিহ্যবাহী নগর আর আধুনিক মেগাসিটির মধ্যে সেই সীমান্ত। সীমান্তটা আজকের দিনে নিতান্তই মানসিক।
এই মানসিক সীমানার প্রভাব অবশ্য পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বেশ ভালভাবে লালন করেন মনে। ঢাকার নতুন শহরে ওই মানসিকতা তো বহুদূরের ব্যাপার, শহরের গঠন এতটাই আলাদা হয়ে ধরা দেবে যে চোখ একটা বন্ধ থাকলেও যে কেউ বলে দিতে পারবে এ পুরাতন ঢাকা নয়। শুধু একটা এলাকায় ব্যাপারটা নিয়ে হালকা সন্দেহ জাগতে পারে। জায়গাটার নাম মোহাম্মাদপুর! মোহাম্মাদপুর অবশ্য পুরাতন ঢাকার মতই বদলে যাচ্ছে। ডেভেলপারদের বিশাল বিশাল বিল্ডিং জায়গা করে নিচ্ছে। কিন্তু এখনো অলি গলিতে ঢাকা শহরের এককালের ঘরোয়া স্কেল এর দেখা পাওয়া যাবে পুরাতন ঢাকার মত। সাথে মানুষের মোগলাই খাদ্যাভ্যাস, ছোট সরু রাস্তাঘাট আর গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাড়ি সাক্ষ্য দেবে মোহাম্মাদপুর পুরাতন ঢাকারই দূরে সরে থাকা সন্তান।
মোহাম্মাদপুরের অলিগলিতে আমার চলাফেরা প্রায় দেড় যুগের। মুক্তিযুদ্ধে বিহারী ক্যাম্পের অবস্থান, ফিজিকাল কলেজ এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টর্চার সেল আর মধ্যবিত্তের দোতলা-তেতলা বাসাগুলি গত শতকের ইতিহাস এর কত স্পর্শ বহন করে চলেছে তাঁর হিসাব আসলে কেউ জানে না। মোহাম্মাদপুরকে বলা যায় ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসন। কিন্তু মোহাম্মাদপুরের ইতিহাস আসলে আরো অনেক অনেক পুরাতন! মোহাম্মাদপুরে নতুন সব বহুতল ভবন আর ৭০ এর দশকের লুপ্ত হতে থাকা শান্তিময় বাড়িগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে মুঘল আমলের নিদর্শন!
ঢাকা শহর মোঘল সুবাহর রাজধানী হিসাবে যাত্রা শুরু করে ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁর হাত ধরে। এরপর মীর জুমলা, শায়েস্তা খাঁ, নবাব আলীবর্দী খাঁ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলের শাসক হন। নামে মুঘল শাসন এর অধীনস্ত হলেও দূর্গম যাতায়াত ব্যাবস্থা, ভিন্ন আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং দিল্লী সালতানাত এর সাথে বিশাল দুরত্বের কারণে বাংলা কার্যত স্বাধীন ই ছিল। মুঘল সুবাহর অধীনে ঢাকার নাম রাখা হয়েছিল জাহাংগীরনগর। ঢাকাকে রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে মুঘল সুবাদারেরা সম্রাটের নামে সারা বাংলায় দখল প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। কিন্তু ১৬১৫ সাল থেকে আহোম সম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে কোনভাবেই মুঘলরা পেরে উঠছিল না। এই অবস্থায় সম্ভবত একটি বিজয় তাঁদের দরকার ছিল। সেই বিজয় আসে আরাকাণদের বিরুদ্ধে। আরাকাণদের চট্টগ্রাম, থিরি থুধাম্মার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে শায়েস্তা খান তাঁর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। ১৬৬৬ সালে এই বিজয়ের পর শায়েস্তা খাঁ রাজধানী ঢাকাকে সন্নিবেশিত করতে মন দেন। ধারণা করা হয় মোহাম্মাদপুরে জনবসতির শুরু এই সন্নিবেসনকাল থেকেই বেশ বেগ পায়। পুরাতন ঢাকার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী স্থাপণা হিসাবে যেমন টিকে আছে লালবাগ কেল্লা, তাঁর সমসাময়িক স্থাপনার তালিকা করলে তালিকায় স্থাপত্য রয়ে যাবে শুধু দুইটি। ধানমন্ডির মুঘল ঈদগাহ আর রয়েছে সাত গম্বুজ মসজিদ। সাত গম্বুজ মসজিদই মানুষের মুখে মুখে সাত মসজিদ হিসাবে পরিচিত হয়ে গিয়েছে সময়ের আবর্তে। এ মসজিদের নির্মাতা সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এর ছেলে উমাইদ খাঁ।
মসজিদ হিসাবে সাত গম্বুজ মসজিদকে বলা যেতে পারে নিতান্তই ছোট। আয়তাকার নামাজকোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। ভেতরে চার কাতারে একশত লোকের নামাজ এর ব্যাবস্থা রয়েছে। পশ্চিম এর দেয়ালে তিনটি মেহরাব। আর পূর্বদিকের দেয়ালে তিনটি খিলান একই বরাবর। সাত গম্বুজ মসজিদের নাম সাত গম্বুজ কেন এ নিয়ে আসলে খুব বেশি চমক নেই। এর ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অনু গম্বুজ থাকাতেই একে সাত গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। এর মিনারের (turrets) সংখ্যা চারটি।
সাত গম্বুজ মসজিদ এর নকশা (Plan) (সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া।)
মুঘলদের সাথে স্থানীয় দ্রাবিড় বা আরাকাণীদের স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় পার্থক্য সম্ভবত চিন্তাধারার আকারে। মাত্র ১০০ জনের মসজিদের জন্য সামনে সুবিশাল উদ্যান, জ্যামিতিক সমতা আর লাল পাথরের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলিই সাক্ষ্য দেয়- মুঘলদের বিখ্যাত স্থাপত্যরীতির জাকজমক কতটা সুবিশাল ছিল। তবে এই মসজিদ এর আসল চেহারাটা সম্ভবত এখন আর কোনভাবেই ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই। অনেক বড় স্থপতিই বলেন, যে কোন স্থাপনা আসলে কতটা সফল তাঁর অর্ধেক ঠিক করে দেয় তাঁর স্থান ও কাল এর প্রাসংগিকতা। কালের হিসাবে মুঘল স্থাপত্য হিসাবে সফলতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই এই মসজিদের ক্ষেত্রে । এর স্থাপত্যশৈলিতে মুঘল ঘরাণার প্রভাব স্পষ্ট। স্থানীয় নির্মাণ উপকরণের সাথে মুঘল রীতির যে মেলবন্ধন লালবাগ কেল্লায় দেখা যায় তা নিঃসন্দেহে এখানেও দেখা যায়। এমনকী মুঘল প্রকৌশল এর ও কিছু অসাধারন ছোয়া রয়েছে এই মসজিদে। এটি এখন বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও আসলে দোতলা। দোতলার বুরুজগুলি নিজেরাই এক একটি স্বতন্ত্র ভবনের মতো। তাঁদের ছাদ গম্বুজের কারণে ফাপা হলেও মেঝে সমতল। সেটার ওজন আবার নিচতলার মোটা দেয়ালে ছডিয়ে দেয়া হয়েছে খুবই সুচতুর ভাবে। এর সাথে অলংকরণে মুঘলদের নিজস্ব প্যাটার্ন এর সাথে মেরলোন ধাচের কিছু অলংকরণ ও দেখা যায়। স্থানীয় অনেক প্রবীন বাসিন্দা দাবী করেন তারা এই মসজিদটিকে দেখতে তাজমহলের মত হওয়ায় “তাজমহল” মসজিদ বলেই ডাকতেন।
কিন্তু সময় এমন এক নিয়ামক যেটা সাত মসজিদ এর স্থাপত্যমূল্যকে কেড়ে নিয়েছে প্রায় নির্মমভাবে। ইতিহাস বলে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল জাফরাবাদ গ্রামে,নাম না জানা এক নদীর তীরে। নদীটি বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মসজিদের সাথে নদীর ঘাট ছিল সে সময়। নৌকা ভিড়ত সেই ঘাটে। বর্ষাকালে বড় বড় বজরা এসে ভিড়ত নদীর ঘাটে। পুরাতন ঢাকার নামজাদা পরিবারের সদস্যরা আসতেন নামাজ পড়তে। শুকনো মৌসুমে এরা আসতেন টম টম এ চড়ে। এই বর্ণনার সাথে মিল পাওয়া যায় চার্লস ডি ওয়াইলির ১৮১৪ সালে আকা মসজিদটির একটি স্কেচ এর। যেখানে মসজিদটিকে কিছুটা জরাজীর্ন অবস্থায় দেখানো হয়েছে। তবে নদীর আকার ও মসজিদের স্কেল রীতিমত চমকে দেয়।
১৯৮৮ সালের বন্যাতে মসজিদের বেশ ক্ষতি হয়। পানি উঠে যায় মসজিদ প্রাংগণে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তখনো মসজিদটিকে অনেক দূর থেকে দেখা যেত। এমনকি স্থানীয়রা বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও অনেকদিন মসজিদের চারপাশ ঘেষে বিস্তৃত জলাধার ছিল। মিরপুর ব্রিজ এর উপর দাঁড়িয়ে তাকালে মসজিদটি আলাদাভাবে চোখে পড়ত। মসজিদের প্রবেশ এর জন্য একটি মাটির পথ ছিল মাত্র।
৩০ এর দশকে সাত গম্বুজ মসজিদ (ছবিঃঅলিগলি)
৮০ এর দশকের সাত গম্বুজ মসজিদ (ছবিঃ অলিগলি)
৯০ এর দশকের শুরুতে সাত গম্বুজ মসজিদ (ছবিঃ নাম না জানা দৈনিক পত্রিকা)
২০০০ এর দশকের শুরুতে সাত গম্বুজ মসজিদ (ছবিঃউইকিমিডিয়া)
সাতগম্বুজ মসজিদ থেকে জিগাতলা পর্যন্ত রাস্তাটার নামই এখনো পর্যন্ত সাত মসজিদ রোড। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার একটি অংশ তৈরিই হয়েছে এই রাস্তাকে কেন্দ্র করে। মোহাম্মাদপুর বাস স্ট্যান্ড পার হয়ে বাশবাড়ির পাশের ২০ ফিটের ছোট রাস্তায় প্রায় নিভৃতে পড়ে আছে সেই রাস্তার গন্তব্য সাত গম্বুজ মসজিদ। একদম নিভৃতে বলা অবশ্য ভুল হল। এই মসজিদের একটি রহস্যময় সঙ্গী আছে। সেই সঙ্গী হচ্ছে একটি নাম না জানা সমাধি। সেই ২০ ফিট রাস্তার অন্য পাশে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে এই সমাধি। কেউ কেউ বলেন এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। কিন্তু মসজিদ এবং সমাধি কোনটির ই শিলালিপি বা ফলক আর যথাস্থানে নেই। তাই নিশ্চিত হবার উপায় নেই মসজিদ এর প্রতিষ্ঠার যথার্থ সাল বা সমাধির মাঝে শুয়ে থাকা নাম না জানা মানুষটির পরিচয় সম্পর্কে। তবে মসজিদের পাশে মুঘল আমলের না হলেও পরবর্তী সময়ে কিছু স্থানীয় মানুষকে কবর দেয়া হয়। মসজিদের সামনে বিস্তৃত বাগানটির এক অংশ এখনো কবরস্থান হিসাবে কাজ করে।
মসজিদের পার্শ্ববর্তী রাস্তার অপর পাশে নাম না জানা সমাধি। (সূত্রঃ Knowshin, Wikimedia)
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বেশ কিছুদিন হয় মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এর দায়িত্বে আছে। মাঝে সাদা রঙ করে দেয়া হলেও পরবর্তীতে আসল রঙ ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সমাধিটি অবশ্য সাদাই রয়ে গেছে এখনো। তবে নিকটবর্তী জায়গাগুলো আমাদের ভূমিলালসা আর কংক্রিট গাথার ধ্বংসাত্বক স্বভাবের শিকার হয়ে যাওয়ায় মসজিদটি টিকে আছে প্রায় লুকিয়ে। বিস্তীর্ণ নদীর বদলে মসজিদের লাগোয়া মাদ্রাসার বিশাল ভবন বা নতুন তৈরি হতে থাকা সুবিশাল আবাসন প্রকল্প মসজিদের স্কেল, স্থাপত্যের বিশুদ্ধতাকে অনেক আগেই গ্রাস করেছে। বর্তমান সময়ে কিছু স্থাপনাকে মসজিদের মালিকানাধীন এলাকায় ঢুকে পড়তেও দেখা যাচ্ছে।
নামাযের বাইরেও মসজিদটি ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনস্থল হিসাবেও কাজ করে। (ছবিঃ আসিফ আহমেদ মজুমদার-উইকিমিডিয়া)
ঢাকা শহরে মসজিদ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি এর অপরিকল্পিত আকার আকৃতি, বেঢপ ধরনের নকশা ও যথোপযুক্ত সামাজিক দিকনির্দেশনার অভাবে। অথচ মুঘল এই মসজিদের মধ্যে নগরের গৌরব ও সামাজিক বনেদিয়ানার সবটুকু দিকনির্দেশনাই ছিল। প্রায় ৩৪০ বছর ধরে ঢাকার নগরায়নের সাক্ষী এই মসজিদ ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্থাপনাগুলোর একটি। হয়তো কোন একদিন মসজিদ এর হারানো শৌকর্য ফিরিয়ে আনার মত মানসিকতা ফিরে আসবে নগরবাসীর মনে। ভাবতে ইচ্ছা করে সেইদিনের অপেক্ষায় মসজিদটি যেন লুকিয়ে হলেও মানুষের আগ্রহ আর কৌতুহলের বিষয় হয়ে বেঁচে থাকবে!
এই লেখাটি ঈষৎ পরিমার্জিত আকারে Walk Bangladesh এর স্থাপত্য ও ভ্রমণ ব্লগে প্রকাশিত হয়
লেখাটির লিংকঃ https://www.walkbangladesh.com/seven_gombuj_mosque/
এই লেখাটি ঈষৎ পরিমার্জিত আকারে Walk Bangladesh এর স্থাপত্য ও ভ্রমণ ব্লগে প্রকাশিত হয়
লেখাটির লিংকঃ https://www.walkbangladesh.com/seven_gombuj_mosque/
Comments
Post a Comment