কিছুদিন আগে Context BD পূর্বপুরুষের ঘরবাড়ি নিয়ে উত্তরপুরুষকে চিঠি- এই ধরনের একটা লেখা সংগ্রহের ক্যাম্পেইন চালায়। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে চিঠি লিখতে বসি। কিন্তু মনের সুখে লিখতে লিখতে শেষ হলে শব্দ গুনে দেখি শব্দের বন্ধনী পার হয়ে দ্বিগুন তিনগুন চলে গেছি। বেশি কথা বলা অভ্যাস। থামতেই যে পারিনা। তাই সেটা আর জমা দেয়া হল না। গতকালকে সেটা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
প্রিয়”,
আমি জানি না তুমি আমার কততম প্রজন্মের উত্তরসূরী। আমার জানা নেই দুনিয়ার কোন জানা বা অজানা বা চেনা বা অচেনা মাটির বুকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার বিধি আমার ভাগ্যনামায় লেখা ছিল। আমি জানি না কোন মাটির গন্ধ নাকে নিয়ে বা কোন আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে শেষবার বুকভরে শ্বাস নেব। আমি আমার কল্পনায় ভাবি, তুমি হয়তো কোন তারার দিকে তাকিয়ে খুজে বেড়াও সেই মাটির গন্ধ যেখানে তোমার পূর্বপুরুষের ভিটামাটি ছিল একদিন। হয়তো তোমার মনে প্রশ্ন আসে সেই ভিটেমাটির উপর আছড়ে পড়া বর্ষার জল কতটা স্বচ্ছ। কিংবা কে জানে হয়তো তুমি দূরের কোন গ্রহে বসে তোমার সেই রঙ না জানা আকাশে মিটিমিট করে জ্বলা তারাগুলির মাঝে আমার তোমার প্রশ্নগুলি মিলে মিশে একাকার হয়।
গিরিবাজ পায়রার ডিগবাজি দেখার স্মৃতি আমার মানসপটে উঠে আছে যেখানে সেই জায়গাটির রঙ স্বর্নালী। রোদ পড়ে সোনারঙে ঝকমক করতে থাকা সেই স্মৃতিগুলিতে যেসব ঘরবাড়ি রয়েছে সেগুলো সব মাটির তৈরি। দোতলা মাটির ঘর, তাঁর উপরদিকে রঙিন কাঠের কারুকাজ, কাঠের ছাদ ধরে রাখতে একের পর এক টানা দেয়া কড়িকাঠ। এই স্মৃতিগুলি যে জায়গার সেখানে জন্ম হয়েছিল আমার মায়ের। সে যুগে কোন ছবি তোলার সরঞ্জাম ছিল না আমার মাতামহের। তাই আমার মায়ের জন্মের মত মাতৃগৃহের জন্মকালীন কোন ধারণা আমার নেই। তবে আমার মনে আছে জায়গাটির নাম “হরিণী”। নাটোরের সিংড়া উপজেলার অজপাড়াগায়ের নামের সাথে আমার মনে আছে কিছু মরচে পড়ে যাওয়া স্মৃতি।
সেই স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে বারে বারে ফিরে আসে সেই সোনালি রঙ। আমার তখনো কোলে ওঠার বয়স শেষ হয় নি। হেমন্তকাল বাংলা বর্ষের পঞ্জিকায় তখনো টিকে আছে সগৌরবে। স্কুল কলেজের গন্ডিতে না ঢোকা আমাকে কোলে নিয়ে সোনালি ধানক্ষেতগুলি হেঁটে হেঁটে পার হয়ে যেতেন আমার বাবা অথবা মা। দিগন্তরেখায় আমার চোখ ঘুরে বেড়াত অসীম কৌতুহল নিয়ে। সেখানে কোথাও সবুজ যেসব ছিটে দেখা যাচ্ছে সোনালী সাগর ছাপিয়ে সেগুলোর কোনটাই হয়তো হরিনী। সেখানে তাঁর চেয়েও সোনালী রঙের চশমার ফ্রেম পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন হয়তো আমার বুড়ো নানাভাই। তাঁর মুখটি অবশ্য লাল। ধান মাড়াই এর শব্দে মুখরিত বাড়ির সম্মুখভাগ থেকেও অনেকটা এগিয়ে এসে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন।
উত্তরবঙ্গের তীব্র শীতের সাথে মানুষের তেমন আদর আহলাদের সম্পর্ক নেই। কিন্তু ধান মাড়াই এর পরবর্তী সময়ের আলস্যটা সেটা পূরণ করে দিত। সেই অলস সময়টাতে আমার নানীজান বসে বসে কাথা সেলাই করতেন। তাঁর মনে অবশ্য তাড়া। সেই সেলাই করা কাথাগুলি সবার অগোচরে বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় আমাদের সাথে দিয়ে দেবেন তিনি। এই সময়টায় বাড়ির রান্নাঘরের পাশে যে একচিলতে জায়গা ছিল সেখানেই গিরিবাজ পায়রার খোয়াড়ের নিচে সূর্যের আলো এসে পড়ত। নানীজানের চোখে চোখে থাকতে থাকতেই চলত সেই জায়গায় আমার দাপাদাপি। আগ্রহের বস্তুর অবশ্য কমতি নেই। মাথার উপরে পায়রার খোয়াড় থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ত মুরগীর খোয়াড়ঘর ও। সেখানে কয়েকজোড়া হাস মুরগী একসাথে কীভাবে থাকে- এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল নানীজান সেই ঘরের ভেতরে হাত দিয়েই কীভাবে খুবই ছোট ছোট লালচে রঙের ডিম যেভাবে বের করে আনতেন। তবে তাঁর জাদু এখানেই শেষ নয়। রান্নাঘরের টালির চাল থেকে তিনি নামিয়ে আনতেন পুটিমাছ। আগেরদিন ধরে আনা মাছগুলিকে সারারাত তিনি রেখে দিতেন কুয়াশা আর শিশিরের হেফাজতে। তিনি বলতেন সারারাত এখানে থেকে পুটিমাছের গায়ে জমবে সর। সেই “সরপুটি”র তরকারীতে তিনি বাগাড় দিতে বসলে আমি সঙ্গের জন্য ছুটে যেতাম নানাভাই এর কাছে।
তবে তাঁকে আবার খুজতে হত বেশ। প্রথমে যেতাম দোতলায় তাঁর বানানো চৌকি আর কাঠের ট্রাঙ্কের লাইব্রেরিতে। কাঠের সিড়ি বেয়ে ওঠার সময় যে ধুপধাপ শব্দ হত তাতে বেশিরভাগ সময়েই তিনি জেগে যেতেন। তবে ঘরে তাঁকে না পাওয়া গেলে আমি অযথাই ঘরের চারদিকে থাকা ৫ ফুটি টানা বারান্দায় এক দৌড় দিয়ে নিতাম মনের সুখে। সেখানে অবশ্য আগ্রহের কারন ছিল মেঝেতে কয়েক জায়গায় লুকিয়ে থাকা ছিদ্র। সেগুলি দিয়ে নাকি ডাকাত দমন করা যেত কোণকালে। নানাভাইকে দোতলায় না পাওয়া গেলে অবশ্য আমার জানা ছিল তিনি কোথায় থাকবেন। তবে সেক্ষেত্রে তাঁর সন্ধানে আমাকে যেতে হবে বাড়ি, বাড়ির ভেতরের ইট বিছানো উঠান, ধান জমিয়ে রাখা বড় বড় চাড়ি, আধাখোলা বৈঠকখানা ঘর, দই জমাতে দেয়া খাবার ঘর আর সামনের একচিলতে বারান্দা পার হয়ে। ধান মাড়াই এর জন্য বাড়ির সামনের সুবিশাল প্রাঙ্গণে তখন খড়ের গাদা তৈরির কসরত চলছে। সে আরেক দৃশ্য। খড়ের গাদার মাথায় দাঁড়িয়ে কি এক কারিগরি বিষ্ময় দিয়ে পালা তৈরি করছে বাড়ির কোন কর্মচারী। আমার নানাভাইকে পাওয়া যেত অপ্রস্তুত বা আধাপ্রস্তুত কোন খড়ের গাদার ভেতর। কোন বই এর অর্ধেক পড়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছেন ভরদুপুরেই খড়ের আর সূর্যের ওম ওম উষ্ণতার স্বাদ পেয়ে।
নানাভাই এর সাথে আমার যাবতীয় সখ্যের কারণ অবশ্য বেশ কয়টি। দিনের আলো থাকতে তিনি আমাকে জাদু দেখাতেন। নানাভাই এর একটা জাদুর ঘর ছিল। সেখানে তিনি গবেষক, তিনি জাদুকর এবং তিনি শিক্ষক। অবসরে বসে বসে গ্রাম্য উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন তিনি। সাধারণ থেকে শুরু করে বোয়াল মাছ ধরার বড়শি, কাক তাড়ানোর জন্য কাকতাড়ুয়া থেকে মাটির ঢেলা থেকে তীর সব ছুড়ে মারতে পারঙ্গম ধনুক কিংবা দাঁতের কাঠি জমিয়ে রাখার জন্য হাতে বানানো বাঁশের চোং দেখিয়ে মাঝে মাঝেই তিনি অবাক করে দিতেন আমার ছোট মনটিকে। কোন কোনদিন সেই বড়শি হাতে অধৈর্য্য হয়ে মাছের আশা বসে থাকা আমাকে হতভম্ব করে দিতেন কোমর পানিতে নেমে খালি হাতেই খপ করে দুটো মাছ ধরে ফেলে। আমি তাঁর ধরে জমিয়ে রাখা মাছের ডোঙ্গায় তাকিয়ে বুঝতে চাইতাম রুই আর কাতলা মাছের চোখের রঙ কী হয়।
তবে আরো বেশি অবাক করতেন তিনি সন্ধ্যার পর। ওইদিকের সরল মানুষের ভাষায় “কিচ্ছা” বলে। সেই কিচ্ছা কোনদিন শুরু হত কোহকাফ নগরে তো কোনদিন ঠিক পাশের বাড়িতে। সেই গল্পের নায়কেরা সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াত। থেমে থাকতনা এক মুহুর্ত ও গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু দুটি জিনিস চলত মহাকালের সাথে সমান্তরালে। একটি ছিল আমাদের সবার মাঝে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা কেরোসিন বাতির আভা আর অন্যটি সব “কিচ্ছা”র আবহ সংগীতে বাজতে থাকা ঝিঝিপোকার ডাক। আজ মহাকালের সামনে দাঁড়িয়ে সেই বাড়ির প্রতিটি কোণা কেমন আছে আমার জানতে ইচ্ছা করে। সেই ঝিঝিপোকাগুলির ডাক যেমন আমি চোখ বন্ধ করে মনে করতে পারি, তেমনি মনে করতে পারি পাটের শিকায় ঝুলিয়ে রাখা ঝোলাগুড়ের রঙ, মনে করতে পারি তাঁর নিচে কোনদিন কেউ খেতে না বসা খাবার টেবিলে জমিয়ে রাখা নানাভাই এর আয়ুর্বেদ সালসার বোতল কিংবা সবার জমায়েতের জন্য রেখে দেয়া নিচু কিন্তু ছড়ানো চৌকির উপর বিছানো শীতলপাঠির খসখসে জমিন। সাথে আরো মনে পড়ে বাড়ির লুকানো বেড়ার পেছন দিকে কামরাঙ্গার গাছ, বাড়ি থেকে কয় কদম দূরে আমবাগান দেখিয়ে আমার নানাভাই এর গর্ব করে বলা-“বুঝলি, এ হল আমার সুন্দরবন।“
ওই বাড়ির পুরু মাটির দেয়ালে জানালা বসালেও দেয়ালের ভেতরে অনেকখানি জায়গা থেকে যেত। সেই জায়গাটিতে আমার নানীজান আচার আর জমে যাওয়া নারিকেল তেল শুকাতে দিতেন। তাঁর সামনে আমি সোৎসাহে লাঠি নিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করতাম কাল্পনিক কাকগুলিকে যথাসময়ে তাড়িয়ে দিতে। সেই জানালা দিয়ে রোদ ভেতরে আসত যখন ততক্ষণে নানীজানের রান্নাঘরে খেজুরের রসের জোগান এসে গেছে। আধাখোলা রান্নাঘরে কেউ বড় খোলা বাসনে জ্বাল দিয়ে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে ঝোলা গুড়। তাঁর সামনে থাকা মহিষের গোয়ালে রাখালের হাকডাক ও শোনা যাচ্ছে। মহিষের হাকডাক সকালের পর শোনা যাওয়া অবশ্য মন খারাপের কারণ ছিল আমার জন্য। এর মানে হচ্ছে যাবার দিন চলে আসছে।
যেদিন চলে যাব ওই সোনালী বাড়িটিতে অবশ্য কান্নাকাটি হত না। বরং মহিষের গাড়ি আর রাখালের হাকডাকের সাথে আমাদের ব্যাগ বোচকা টানতে আসা লোকদের সমাগমে ছোটখাট হাটবাজার বসে যেত। শুধু নানাভাই একটু উদভ্রান্ত হয়ে কয়েক কদম আসতেন মহিষের গাড়ির পেছনে। তাঁর চেহারা অনেক দূর থেকে দেখা যেত না। নানীজানকে চলে আসার সময় দেখার সৌভাগ্য হয় নি আমার কখনোই।
প্রিয় উত্তরসূরী, তোমাকে আমার একটি স্মৃতি জানাতে চাই। আমি যেদিন শেষবারের মত ওই সোনালীরঙা, গিরিবাজ পায়রা ওড়া, কাঠের কড়িকাঠে গড়া মহলটি ছেড়ে চলে আসি সেদিন ও আমার নানীজানের সাথে আর দেখা হয় নি। কীভাবে হবে বল? তাঁকে যে দুইদিন আগেই আমরা চিরকালের জন্য শুইয়ে এসেছিলাম আমার নানাজানের সুন্দরবনে কোন নাম না জানা আমগাছের ছায়াতলে। কুপির বাতি সেখানে হয়তো আমরা জ্বালতে পারিনি। কিন্তু ঝিঝি পোকার ডাকের সাথে নানীজান আর ওই বাড়ির স্মৃতিও সেখানে জায়গা করে নিয়েছে মহাকালের না থেমে থাকা ঘটনাগুলোর চিরায়ত খাতায়। আমার নানাভাই সেদিন ও উদভ্রান্তভাবে তাকিয়ে ছিলেন।
আমি জানি উত্তরসুরী তোমার আরো প্রশ্ন আছে। আমি জানি তুমি জিজ্ঞেস করতে চাও- সে বাড়ির মাটিতে কি আলাদা কোন ঘ্রাণ ছিল? তুমি জানতে চাও ওই বাড়ির টালি খড় আর টিনের চালে বৃষ্টির শব্ধ আলাদা হয় কী না। তুমি হয়তো শুনতে চাও ওই বাড়ির ভেতরের উঠান থেকে আমি নাম না জানা তারার দিকে নানাভাই আর নানীজান তাকিয়ে থাকতেন কী না।
আমি কি চাই জান? আমি চাই তোমার জানার ইচ্ছা হোক। আমি চাই তোমার প্রশ্নের মাঝে বেঁচে থাকুক আমার ক্ষয়ে ক্ষয়ে বেঁচে থাকা হরিনীবাসী আদিপরিবারের স্মৃতি।
ইতি,
তোমার নাম ও ক্রম না জানা পূর্বপুরুষ।
Comments
Post a Comment