চন্ডীগড় শহরে স্থাপত্য দেখার ব্যাপারটা প্রায় কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনের ছকের মধ্যে
আরেক কর্তব্য ছিল সেখানকার আর্কিটেকচার স্কুল ঘুরে দেখা। এই দেখার ফাকে একজন শিক্ষক
জানতে চেয়েছিলেন- “এই যে ৪০-৪২ দিনের ভারত দেখে বেড়ানোর বিশাল আয়োজন, এর মধ্যে কোন
শহরে কতদিন বরাদ্দ?” ৪০ দিনের বাধা ছকে গোয়া’র জন্য বরাদ্দ পাঁচদিন শুনেই মুখ টিপে
হেসেছিলেন অনেকে।
![]() |
গোয়া যেন ভারত মহাসাগরের তীরে স্বাধীনতার ডাক (ছবিঃ সেহরান পারভেজ সিয়ান) |
আমরা ভারতবর্ষে
প্রথম ঘুরতে আসা স্থাপত্য ব্যাচ নই। এই ঐতিহ্য ঠিক কতদিনের পুরাতন তা নিয়ে বেশ একটা
ধোয়াশা আছে। তবে বছরের হিসাবে ৩০ এর কম তো নয় ই। এমনকি আমাদের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক
ও তার ভারতভ্রমণ এর রেফারেন্স টানেন ঐতিহাসিক স্থাপত্য পড়াতে। গোয়া শহর নিয়ে শুধু চন্ডীগড়ের
শিক্ষকেরা নন শুধু আমাদের নিজেদের মধ্যেও বাড়তি উত্তেজনা স্পষ্ট। গোয়া হচ্ছে- স্বাধীনতার
নগর! মুম্বাই এর মত কসমোপলিটান নয়, কক্সবাজারের মত বিশ্বের বৃহত্তম সৈকত ও নয়, গোয়া
শহর এর স্বাধীনতা একটা সাগরকণ্যা ছোট শহরে দাঁড়িয়ে সাগরপাড়ের জীবনের সর্বোচ্চ স্বাধীনতার
হাতছানি! কী না কী হবে সামনে! কত কত গল্প শুনে যাচ্ছি, তার সব কি সত্যি?
চন্ডীগড় থেকে
গোয়া শহরের দুরত্ব ২২০০ কিলোমিটার। এই পথ আসতে আসতে আসতে মুঘল, রাজপুত ও বৃটিশদের সকল
গৌরবগাথা দেখার পর্বটা পার হয়ে গেছে। আমার ডান হাত ভেঙ্গে গেছে এক মামুলি দূর্ঘটনায়
এবং পর্তুগীজ স্থাপত্য দেখার কেতাবি আগ্রহ ছাপিয়ে সবার মনে বাসা বেধেছে মাসখানেক এর
লম্বা ভ্রমণের অবসাদ। এই অবসাদ এ আক্রান্ত রা ছবি তুলতে চায় না, চোখে দেখতে চায়, মনে
রাখতে চায়। কাল সকালে কী হবে- এই চিন্তা ছাপিয়ে মাথায় বাসা বাধে বিশ্বজগতের একমাত্র
জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া গ্রহের কত যৎসামান্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে বা হবে আদৌ এই ধরনের
চিন্তা।
এই ধরনের চিন্তাভাবনা
যদি রোগ হয়, তাহলে তার লক্ষণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি স্মৃতি তৈরি করা এবং সেটা করতে কোনভাবে
নিজেকে জোর না করা। এই শহরে সবাই স্কুটি বা মোটরবাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওই যে সেই
স্বাধীনতার শহর! যেদিকে দুই চোখ যায় চলে যাওয়ার ব্যাপারটা এই কারনেই জনপ্রিয় হতে হতে
প্রায় মনোপলি। কিন্তু যার হাত ভাঙ্গা তার এই স্বাধীনতা কোথায়? সাদিয়া অবশ্য বরাবরের
মত আমাকে বাচিয়ে দিল “চল একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলি!” এই বুদ্ধি দিয়ে! কোথায় ঘোরাফেরা
হবেনা বলে মন খারাপ করব, তার বদলে ভাবতে থাকলাম গাড়ি থাকলে তো অনেক সুবিধা রে! আমার
মত আরেক অভাগা হাত পা ছুলে ইনফেকশান বাধিয়ে ফেলা অর্থী আর পা মচকে হায় হায় করতে থাকা
সিয়ান ও জুটে গেল। ( অর্থীকে অভাগা তাকে বলা যায় না। কেন সেটা অন্য কোন এক পর্বে) কিন্তু
প্রশ্ন হচ্ছে গাড়িটা চালাবে কে? গাড়ির কথা শুনে পিউলি বেশ নিস্পৃহ গলায় বলল- “আচ্ছা
অটো ট্রান্সমিশান হলে আমি কিন্তু চালাতে পারব”। অনেক খোজাখুজির পরে যখন প্রায় হতাশ
হয়ে বাদ দিচ্ছি, তখন একটা অটো গাড়ি পাওয়া গেল! বেশ নতুন মডেলের হিউন্দাই।
গাড়ি পেয়ে
আমরা এতই খুশী যে অকারণে কোন প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়া দুই চার ব্লক ভো ভো করে ঘুরে ফেললাম।
এরপর গোয়ার স্বাভাবিক নিয়ম মেনে এই বিচ ওই বিচ, সাগরপাড়ে এলিয়ে থাকা এই করে একদিন চলে
গেল। পরেরদিন সকালে বেশ সিরিয়াস ভাবে আমি বললাম- আমাদের আসলে দূরে কোথাও যাওয়া উচিত
(গাড়ির বিস্তর মাইলেজ সম্পর্কে লেখাপড়া করে খুশীতে বাকবাকুম করতে করতে বলা) এর মধ্যে
দুই একজন ট্যুরিস্ট বাবল এর বাইরে পুরাতন গোয়া শহরে ঘোরাফেরা করে এসেছে। গল্প কানে
আসতে থাকল। আমরা বাদ পড়লে গাড়ির মর্যাদা থাকে?
গোয়ার আসল
শহরটি পর্তুগীজদের ঘাটি ছিল দীর্ঘদিন। ব্রিটিশ শাসনের প্রকট প্রভাব থেকে আসা বাংলাভাষী
মানুষ বলে দুই জাতিগোষ্ঠির কলোনিয়াল প্রবৃত্তির মধ্যেও যে বিস্তর পার্থক্য তা চোখে
পড়ে। বৃটিশরা পোড়খাওয়া শাসক। তাদের একাডেমিক স্ট্রাকচার এর দিকে গভীর মনোযোগ। তারা
ট্রেন স্টেশান বানিয়েছে, সাহেবি কায়দায় জীবন যাপন করেছে এবং বিশ্বভারতী সংস্কৃতির সাথে
স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেদেরটা মিশিয়ে ফেলেছে। পর্তুগীজরা দূর্গ হয়তো দুই চারটা বানিয়েছে
ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি চোখে পড়ে তাদের ধর্ম নিয়ে স্পিরিচুয়ালিটী আর তাদের বিখ্যাত
বিষণ্ণ আনন্দের আভাস। ইউরোপে বলা হয় পর্তুগীজ জীবনের মূল সূত্র সব কিছু নিয়ে অদ্ভুত
বিষন্নতা। পুরাতন গোয়ার পথে প্রান্তরে ইউরোপিয়ান ভাবধারার পর্তুগীজ রূপ ধরে আছে চার্চ,
মলিন রঙ এর পুরাতন ভবন আর দুপুরের খা খা নীরবতা।
ম্যাপ দেখে
কোথায় যাওয়া যায় হিসাব করতে করতে অদ্ভুত একটা নাম চোখে পড়ল। Grandmother’s hole
beach! এ আবার কেমন নাম রে বাবা! এই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতেই ৫ মিনিট পর আবিষ্কার
করলাম আমরা পাঁচজনই ওখানে যাবার জন্য নিজেদের কাজ করতে শুরু করে দিয়েছি। উচু নিচু আকাবাকা
রাস্তায় জিপিএস বেশ ঘোল খাওয়াল। আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল দুইজন লোক একটা রঙ্গন
গাছের ডাল পরিষ্কার করছে রাস্তার মাঝে। ডালটা কোন কারণে ভেঙ্গে পড়েছে। তাদেরকেই জিজ্ঞাসা
করলাম আমাদের গন্তব্য আসলে কোথায়? বিদেশী বুঝে নীল জামা পড়া এক ভদ্রলোক দেখিয়ে দিলেন
হাতের ইশারায়। সাথে একটা আলাদা নাম ও বলে দিলেন সার্চ দিতে।
এই জায়গাটা
যাওয়ার জন্য পছন্দ করার কিছু কারণ আছে। জায়গাটা খুবই ছোট এবং জনসমাগম খুবই কম। সাগরপাড়ে
একদমই বিরক্ত না হয়ে বসে থাকার সুযোগ গোয়াতে খুব একটা হয়না। আর আরেকটা কারণ হচ্ছে এই
বিচ এর দিকে হাটাপথের যাত্রা শুরু হয় একটা পাহাড়ের উপর থেকে। প্রায় ১ কিলো আকাবাকা
পথ হেটে সাগর সমতলে নেমে যেতে হয়। যাত্রার শুরুর স্থানে এক জাপানী ভদ্রলোকের তৈরি বাগান
রয়েছে। বিরল সব গাছ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে এনে ভদ্রলোক এখানে বাগান করেছিলেন
কোন কারণে। আমরা এই বাগান এর দিকেই যাচ্ছি। হঠাত করে জিপিএস আবারো উলটাপালটা আচরণ শুরু
করল। আমরা অদ্ভুত ভাষায় লেখা বেশ বড় তোরণ দেখে ভেতরে ঢুকলাম। কোথায় বাগান? এ যে জনশূন্য
জায়গা আর তার সামনে ঢাউস ধরনের বেখাপ্পা একটা ভবন! নিচে অবশ্য সৈকত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু
তার রাস্তাই বা কোথায়? ইতঃস্তত করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি এমন সময় চোখ পড়ল আকাশে। বেশ
বড় ধরনের কিছু কাক আর চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। সিয়ান হঠাত করে বলে বসল- “এই এইটা তো বাগান
না!” ঠিক এই সময় সেই ভবনের গায়ে ছোট ইংরেজি হরফে লেখা দেখলাম “Morgue”! পথ ভুলে মর্গে
চলে আসা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার না। তবে মনে বেশ কু-ডাক দিল কেন যেন! পড়িমড়ি করে গাড়ি
ছুটিয়ে বের হয়ে আসলাম। জিপিএস খুব উদ্ভট আচরণ করছে। তিন ফোনে আমাদের গাড়িটাকে তিনটা
আলাদা জায়গায় দেখাচ্ছে। সব মিলে কেমন চাপা ভয়। এদিকে হাসপাতালের বিশাল বিশাল কোয়ার্টার
রাস্তার দুই পাশে। বারান্দায় কাপড় ঝুলছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই! নড়াচড়া বলতে সেই কাক
আর চিল এর উড়াউড়ি!
প্রায় মাইলখানেক
এর ভুল রাস্তা ফিরে এসে আমরা অবশেষে বাগানটা খুজে পাই। কিন্তু আমাদের “ভারতকল্প”এর
৪২ দিনের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটবে এখানেই, এবং ঘটনার প্রায় আড়াই বছর পর যখন আজকের
এই লেখার পরের অংশ লিখব-ভূত প্রেত আর অলৌকিকতায় নিতান্তই অবিশ্বাসী আমি তখনো জানব না
ঘটনাটার ছোট ছোট ফ্রাগমেন্ট এর ব্যাখ্যা কী! (চলবে)
Comments
Post a Comment