মর্গ
থেকে বেড়িয়ে গাড়ির ভেতরে সবাই একটু ঘোরগ্রস্থ। একই নেটওয়ার্কে চারটা মোবাইলের আলাদা
জিপিএস আমাদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছে। পিউলির অবশ্য এক্সেলারেটরের পা উঠে যায় নি।
গাড়ি চলছেও সেই ঘোরের মধ্যেই। এর মধ্যে জানে পানি আসার মত জিপিএস ঠিকমত লোকেট করে ফেলল
সবাইকে। রেডিও সিগনাল ও ফেরত এসেছে। মর্গ এর ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে করতে
জায়গামত এসে পৌছে গেলাম আমরা। এই সেই জাপানী ভদ্রলোকের বাগান। দেখে মনে হয় ইঞ্চি ইঞ্চি
করে তৈরি করা। অথচ প্রকৃতি থেকেও আলাদা হয়ে যায় নি। আর ওই দূরে ভারত মহাসাগরের কাচের
মত নীলাঞ্জনা হীরার মত পানি! এক চিলতে সাগরপাড় দেখা যাচ্ছে। বহু বহু নিচে! সেখানে কষ্টিপাথরের
মত শৈবাল থেকে আসা কাল পাথর জমাট বেধে আছে কিছু। এই দেখতেই না এতদূর এত পথ ঘুরে আসা!
![]() |
সাগরপাড়ে নেমে যাওয়ার সেই ভয়াল রাস্তা! |
নিচে নামার ব্যাপারটা অবশ্য নিজেই একটা আলাদা জার্নি। আড়াই ফিট চওড়া সিড়ি আছে একটা। তাঁর কোন রেলিং নেই। ঘুরে প্যাচ খেয়ে নেমে গেছে সৈকতে ঠিকই। তবে তাঁর পরতে পরতে আবার ছোট ছোট এডভেঞ্চার! কোথাও পাথর কেটে দরজা তৈরি করে চলে গেছে সিড়ি, তো কোথাও সিড়ির দুইপাশে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছের ছাই। নামতে নামতে চারদিকে তাকালেই মনে হবে আপনি কোন আদিম আমলের অভিযাত্রী। তাঁর চেয়েও আদিম যুগের ট্রেইল ধরে নেমে চলেছেন সাগরের পানি ছুয়ে দেখার লোভে। পথের বাকে বাকে আপনাকে সাবধান করছে কেউ। ভয় দেখাচ্ছে কেউ। সেখানে দুই কদম নামতেই অবশ্য মনোযোগ ঘুরিয়ে নিল এক ফ্রেঞ্চ সুন্দরী। সোনালী চুল আর নেভি ব্লু জামার মহিলার মুখে যেন ক্লাসিক ফরাসী হাসি। এরকম জায়গায় ওই হাসির দিকে নজর না গেলে সেটাই বরং অস্বাভাবিক। ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়ে চলছেন ক্যামেরার সামনে অনবরত। শাটারের শব্দ একপাশে রেখে আমরা হাটা ধরলাম নিচের দিকে। টানা নেমে যাবার ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগে। যখন বুঝতে পারবেন সাগর কাছে চলে আসছে ভাল না লেগে উপায় ই বা কি?
কিন্তু
নামতে নামতে প্রথম মর্গে তৈরি হওয়া অস্বস্তিটা আবার ফিরিয়ে দিল একটা ক্রুশ। গোয়ার বাসিন্দাদের
সিংহ ভাগ ক্রিশ্চিয়ান। তাই ক্রুশ দেখে অবাক হবার কিছুই নেই। কিন্তু ছমছম করে উঠল ক্রুশ
এর শরীর এর লেখাটা পড়ে। লাল কালি দিয়ে সুন্দর হাতের লেখায় ক্রুশ এর বেদিতে লেখা রয়েছে
“He who believes shall never die!” আমার মূল বাইবেল কখনো পড়া হয়নি। তাই কোন ভার্স
বা কোন টেস্টামেন্ট এর অংশ তাও জানা নেই। কিন্তু এভাবে পাহাড়ি রাস্তার পাশে সাদা রঙ
এর ক্রুশ এ লাল লেখায় মৃত্যুর কথা লেখা ব্যাপারটা মনে ধাক্কা দিল বেশ। কিছুক্ষণ সেই
পুরানো ঘোরে তাকিয়ে রইলাম ক্রুশ এর দিকে। তাঁর পেছনে সাগরের দিকে। দুপুরের খা খা রোদে
ভারত মহাসাগর এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি একটা ক্রুশ এর সামনে। কী অবাস্তব অধিভৌতিক ব্যাপার!
জীবন এর কী অদ্ভুত ছোট ছোট বাকবদল। কোনদিন কি ভেবেছি এরকম কোথাও দাড়িয়ে জীবন এর বাঁক
নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা হবে?
পরের
বাকটাতে যেখানে দাঁড়ানো হল সেখানে জনবসতি রয়েছে। পুরোটা নিজেরা হেঁটে এসে মানুষ দেখলে
দাড়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখানে আবারো সেই অস্বস্তির ধাক্কা। গোয়া একটা ট্যুরিস্ট এর
শহর। শহর গিজগিজ করে মানুষে। বহিরাগত মানুষ ই বেশি। আর ট্যুরিজম এর উপরে যেহেতু এই
শহরের ব্যাবসা বাণিজ্যের ভিত্তি দাড়া করানো ট্যুরিস্ট রা তাই সবখানেই সাদরে আমন্ত্রিত।
মানুষের মুখে সব সময় অভ্যর্থণার হাসি লেগেই থাকে। কিন্তু এখানে সেটার ছিটেফোটা নেই।
মানুষগুলো যেন ওই সাগরপাড়ের কালো পাথর কুদেই বানিয়ছেন বিধাতা। কিন্তু সেই চামড়ার সৌন্দর্য্য
চোখে পড়ার আগে চোখে পড়বে হালকা বাদামী রঙ এর অন্তরছেড়া চাউনি! কী তীব্র তাঁদের তাকিয়ে
থাকা! তাঁরা জানে আমার মুখের ভাষা আলাদা। কথা হচ্ছে না তাই। কিন্তু ওই চাউনির জবাব
দেয়ার কোন ভাষা কি আমার কাছে আসলেই আছে? আমারও গায়ের রঙ কালচে শ্যামলা, আমার ও চোখ
বাদামী। কিন্তু এদের এই চাউনিতে কি লেখা নেই যে আমি এদের নিজের জায়গায় অনধিকার প্রবেশ
করছি? এই অস্বস্তির ই বা ব্যাখ্যা কি?
গ্রান্ডমাস
হোল বিচ এর সাগরপাড় কাগজে কলমে খুবই সুন্দর হবার কথা। ইন্টারনেট এ এর বর্ণনা লেখা আছে
লুকানো সৈকত হিসাবে। কালো কষ্টিপাথরের মত পাথর চারদিকে। পেছনের পাথরগুলোতে খনিজ কণা
লেগে অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ তৈরি হয়ে আছে বিধাতার হাতেই! আর প্রবল বেগে ছুটে আসছে আরব
সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউ! ভাঙা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রথম কয় মিনিট ভালই লাগে। সাগর
কী মন খারাপ রাখতে দেয়?
কিন্তু ওই অস্বস্তিটা যে কোনভাবেই তাড়ানো
যাচ্ছে না। চোখের কোণে একটা ভবনের পিছন দিক দেখা যাচ্ছে বহু দূরে। সেখানে সেই কাক চিল
এর উড়াউড়ি। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। এটা যে সেই মর্গ! রাস্তা
ভুল করার কারণটাও এতক্ষণে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। এই সাগর সৈকত এর দিগন্তরেখায় যেদিকে
অসীম নেই, তাঁর অন্তত ২০ ভাগ দখল করে আছে এই মর্গ আর তাঁর উপরে উড়তে থাকা শিকারী পাখি!
কেমন অশুভ একটা ব্যাপার! সাদিয়া আর সিয়ান এর ভৌতিক বিশ্বাস মোটামুটি অন্ধবিশ্বাস এর
পর্যায়ে পড়ে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শূন্য। কিন্তু আমার মন থেকেই যে অস্বস্তি যাচ্ছে
না, ওদের চোখে হালকা ভয় তৈরি হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওদের দেখে অন্তত তেমন
মনে হচ্ছে না। এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতেই একটা
ঘোলা বাদামী চোখের কুকুর পাশ দিয়ে দৌড়িয়ে চলে গেল। কুকুরটা একদম হাড় জিড়জিড়ে। এ যেন
চক্রপূরণ। মানালিতে দেখছিলাম জীবনের সবচেয়ে তাজা আর আদুরে কুকুর। আর গোয়ার সৈকতে দেখলাম
সবচেয়ে অপুষ্ট উদাহরণ। কিন্তু কুকুরটাকে দেখে ডানে তাকাতেই আক্কেল গুড়ুম!
সেই ফরাসী মহিলা! তাঁর জামা উড়ছে বাতাসে।
কিন্তু দুটো অদ্ভুত প্রশ্ন খেলা করে গেল মনে। তাহলে কি আর কোন শর্টকাট পথ আছে নিচে
আসার? কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ক্রুশ এর জায়গাটা বাদে আর কোন বিরতি না নিয়ে সোজা
নিচে চলে এসেছি। মহিলা যদি ক্রুশ এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ও আমাকে অতিক্রম করে আসতেন
নিশ্চয়ই আমার চোখে পড়ত! নাহলে কীভাবে… এ সময় ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম নেভি ব্লু জামা
পড়া আরেকটা লোককে দেখে!
-
আরে! এ তো সেই লোক! যে রাস্তা বলে দিয়েছিল!
প্রায়
স্বগোতক্তির মত বলে তাকালাম বাকিদের দিকে। তারাও আমার মত বিভ্রান্ত আর বিহ্বল। সাদিয়া
বলে “উঠল চল যাই এখান থেকে। কেমন যেন লাগতেছে।“ ফেরার পথে রওনা দিতেই দেখলাম দু’টো
শিশু দাঁড়িয়ে আছে। একজনের কোলে অন্যজন। এতক্ষণ স্থানীয় কেউ আমাদের সাথে কোন কথা বলে
নি। শিশু দুটিকে দেখে কেন যেন আমাদের মনে হল পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বাচ্চাদের সাথে
কথা বলা যেতে পারে। হাতে একটা চকলেট দিতেই বড়জন হেসে ফেলল। আমরাও শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস
করলাম ছোটজন যে কোলে বসে আছে তাঁর নাম কি। আমাদের পুরোপুরি স্তম্ভিত করে দিয়ে সে বলে
বসল
-জিসান!
গোয়ার
সাগরপাড়ে অচেনা গোষ্ঠির নামের মধ্যে নিজের নাম পেয়ে যাওয়ার সুযোগ কতটুকু? ১ ভাগ শতকরা?
কিন্তু আজ মনে হয় সেরকম অদ্ভুত দিন ই! নাম শুনেই কেন যেন সবাই আবার অস্বস্তিতে পড়ে
গেলাম! উপরে গাড়িতে ফেরার সময় তাই তড়িঘড়ি সবার।
কিন্তু
পাহাড় বেয়ে ওঠা তো আর নামার মত সহজ হতে পারে না। আর তাঁর উপর আজকের ভুতুড়ে দিন বা এই
সাগরপাড়ের ভুতুড়ে আভাকে ষোলআনা দিতেই যেন ওঠার পথের দুই ধারে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল
আগুন! লিখে বুঝানো খুবই কঠিন সেই আগুনের মাঝে দিয়ে আগের ক্রুশ, কালীমন্দীর আর ফাটল
দেয়াল পার হয়ে ওঠার সময় মনে কী ধরনের আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে জাপানি বাগানে যখন ফেরত
এলাম- তখন আবার সব শুনশান! কে বলবে গত কয় ঘন্টায় এত কিছু ঘটে গেছে?
গরম
এর তীব্রতা আর আগুনে ভুগে আসাটা অবশ্য রয়ে গেছে। সামনে আইসক্রিম এর গাড়ি দেখা যাচ্ছে।
গাড়ির দরজা খোলা রেখে দু’টো আইসক্রিম খেতে হবে! রাতে রয়েছে গোয়ার বিখ্যাত নৈশজীবনের
হাতছানি। কে জানে? হয়তো ভুলেও যাব এই ভুতুড়ে ঘটনা!
আগের পর্বঃ https://asifzeshan67.blogspot.com/2019/11/blog-post.html
আগের পর্বঃ https://asifzeshan67.blogspot.com/2019/11/blog-post.html
Comments
Post a Comment