Skip to main content

টাইগার্স নেস্টঃ পাইন বনের লোকগাথায়


-“যখন কিওক্রাডং এ উঠি ২০১২ সালে আসলে এত সময় লাগে নি”
কথাটা স্বগোতক্তির মত বললেও অর্থীকেই বলা। অর্থী চার বা পাঁচ কদম সামনে পরের বাঁকটার কোন বিকল্প পথ আছে কী না খুঁজতে ব্যস্ত। আমরা উঠছি “টাইগার্স নেস্ট” এর চুড়া বরাবর। ভূটান আসার আগে ভূটান নামে লিখে গুগলে অনুসন্ধান চালাই বা পোস্টকার্ড বই এর মারফতে যাই জানতে চেষ্টা করি এই টাইগার্স নেস্ট আসবেই। পারো এমনিতেই তর্কসাপেক্ষে ভূটান এর সবচেয়ে সুন্দর শহর। তার সাথে টাইগার্স নেস্ট এ ওঠার বাসনাতে এই মৌসুমে প্রচুর ভ্রমণ পিপাসু লোকজন পারোতে ভিড় জমিয়েছে। আমরা ৩২ জন ও সেই ভিড় এর ই অংশ এবং এই মুহূর্তে ৩২ জনই ভূটানে আসার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি পূরণ করতে ব্যস্ত। এর মধ্যে দেখলাম অর্থী বিকল্প রাস্তা না পেয়ে বাঁকটা পুরো হেঁটে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমিও তাই করলাম। আমাদের দুজনের জন্য আসলে পায়ে হেঁটে উপরে ওঠার চেষ্টাটা আসলে গোয়ার্তুমি অনেকের চোখে। আমাদের কাছে এটা একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ এর মত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ঝাড়া তিন হাজার মিটার উঁচুতে জায়গাটা। পারো ভ্যালির যে জায়গাটা থেকে আমরা এই যাত্রা শুরু করেছি সেখান থেকেও উঠতে হবে প্রায় তিন হাজার ফুট। জিপিএস এর মাপামাপিকে নির্ভুল ধরে নিলে কেওক্রাডং এর উচ্চতাও কাছাকাছিই হওয়া উচিত। কিন্তু ভুটান এ পাহাড়ে ওঠার রাস্তা তৈরি হয় পাহাড়ের গায়ে বাঁক ঘুরে ঘুরে। কদাচিৎ ঢাল বরাবর খাড়া রাস্তার দেখা মিলে। সে হিসাবে হাটাপথ প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এর সাথে যদি উচ্চতা বাড়াতে বাতাসে অক্সিজেন এর পরিমাণ, আমার শ্বাসকষ্টের ইতিহাস আর শরীর স্বাস্থ্যের অবস্থা যোগ করি তাহলে চ্যালেঞ্জটা আসলেই ফেলনা নয়।

এসব ভাবতে ভাবতে ভাবতে আনমনা অবস্থায় ঘোর ভাঙল পাশের বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা শুনে। তিনি হাত নেড়ে হাসিমুখে ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায়- পথের মাঝে দিয়ে না হেঁটে একটু কিনারা বরাবর হাঁটলে পরিশ্রম অনেক কম হবে। তাড়াতাড়িও ওঠা যাবে। হাত নেড়ে ও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। উনি কথা শেষ করে আরেকটা হাসি দিয়ে তীর বেগে হেঁটে হেঁটে সামনে চলে গেলেন। দেশে বিদেশে যেখানেই পাহাড় এ গিয়েছি পাহাড় এর লোক এর সজ্জন মনোভাব কখনো নজর এড়ায় না। অন্য জায়গায় কথা জানি না, উত্তর ভারত আর ভূটান অঞ্চলের বৌদ্ধরা এই ব্যাপারে আরো এক দেড় কাঠি সরেস।

ভূটান সম্পর্কে যেখানেই পড়তে যাচ্ছিলাম
GNH বা Gross national happiness এর কথা চলে আসছিল। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছি এটা একটা দর্শন। যেটা অল্প কথায় একটা বড় জনগোষ্ঠীর সুখের পরিমাণ মেপে ফেলতে পারে। এই তত্ত্ব অনুসারে ভুটানিরা খুবই সুখী জাতি। পুজিবাদী সমাজে বড় হওয়া আমরা টাকা পয়সা বা ভোগ্যপণ্যে সুখ মেপে অভ্যস্ত বলে হয়তো অংকের খাতায় ব্যাপারটা মিলাতে পারব না। তবে ভূটানিরা যে আসলেই বেশ সুখী সেটা কিছুটা হলেও বুঝা যায় তাদের সাথে কথা বললে। গল্প করতে ভুটানিদের কোন ক্লান্তি নেই। এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী যেগুলো ইন্টারনেট এর ক্লীকে বা বই এর পাতায় লেখা তার বাইরেও তাঁদের নিজেদের প্রচলিত লোকগাথা আছে ঐতিহাসিক প্রতিটি স্থাপনার সাথে সাথেই। টাইগার্স নেস্ট ও তার ব্যাতিক্রম নয়।
“টাইগার্স নেস্ট” নামটাও আসলে এরকম একটা লোকগাথার ই অংশ। টাইগার্স নেস্ট এর আসল নাম পারো টাক্সাং (
Paro Taktsang ) একে ভুটানি ভাষায় অনেকে “জংখা” বলেও ডাকে অনেকে। পদ্মসম্ভা নামের একজন গুরু তিব্বত এর খেনপাজং থেকে এই জায়গায় বাঘের পিঠে চড়ে উড়ে আসেন বলে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত জনশ্রুতিতে আছে। এমনকি অনেকে এটাও বলেন যে উঠে আসা বাঘটি আসলে একজন প্রাক্তন ভুটানি সম্রাজ্ঞী যার নাম ইয়েশে শোঘাল। তিনি পদ্মাসম্ভার শিষ্যা ছিলেন। এই গল্পটা ইন্টারনেট এও পাওয়া যায়। তবে যেটা পাওয়া যায় না সেটা হচ্ছে ১৬৯২ সালে যখন তেনজিন রাবগে মঠ বা জঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁকেও ভুটানীরা পদ্মসম্ভার পুনরাগমন এর বাইরে কিছু ভাবতে একদমই রাজি নন। এবং এটাকে প্রমাণ করতে আরো অনেকগুলো গল্প তাঁদের মুখে মুখে ফেরে। এই মঠ এর ভেতরে একটি ভারী ব্রোঞ্জ মুর্তি আছে যা এখানে বানানো নয়। যেটিকে পুরো পাহাড়ের ট্রেইল ধরে টেনে তুলে এনে এখানে স্থাপন করতে হয়েছে। জনশ্রুতি অনুসারে, এই মুর্তিটি যত উপরে তোলা হচ্ছিল তত এর ওজন বেড়ে যাচ্ছিল। একসময় বহনকারী দলের জন্য এটি গন্তব্যে পৌছে দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারা রাস্তায় সেটিকে ফেলে রেখে চলে যায়। দীর্ঘ সময় মুর্তিটি এই অবস্থাতেই ছিল। অবশেষে একদিন এক রহস্যময় লোকের আবির্ভাব হয় এই ট্রেইলে। যার পরিচয় কেউ জানে না। তিনি একাই ভারী মূর্তিটি তুলে নেন এবং বহন করে নিয়ে গিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করেন। এর পরেই তিনি যেন বাতাসে মিলিয়ে যান। এই ব্যাক্তি কে ছিলেন বা কেনই এসেছিলেন তা আজও রহস্যাবৃত।

এই গল্প শুনতে শুনতে আমাদের একদল বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। আমরা বেশ হাঁপিয়ে উঠেছি। ট্রেক করার ট্রেইল আদিম ধরনের। মাঝে মাঝে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ আর বসায় জায়গা রয়েছে। কিন্তু এতটুকুই। আমাদের জন্য আমাদের বন্ধু সিয়ান আর সাদিয়া অপেক্ষা করে আছে আরো খানিকটা ওপরে। ওরা ঘোড়ায় চড়ে অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করে গেছে। দমটা একটু ফিরে আসতেই আমাদের হাটার গতি বাড়াতে হল। কারণ একটাই। সন্ধ্যার পরে এখান থেকে নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা কেবল কঠিনই নয় প্রায় অসম্ভব। পাইন এর বন এতটাই ঘন আর সবুজ যে আলোকিত দিনেও কেউ কোন বাকে হারিয়ে গেলে চিৎকার করে অবস্থান না জানালে হারিয়ে যাওয়া খুবই সহজ। আর ট্রেইল ধরে হাটার ব্যাপারটা অনেকটা সাধনার মত। মনে একটাই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। প্রযুক্তির মধ্যে ডুবে থাকা জীবন থেকে এখানে আসা মানেই একাগ্রতা আর মনোযোগ এর পরীক্ষা প্রতি মুহুর্তে। পরীক্ষায় জিতে গেলে মনজুড়ে অদ্ভুত শান্তি। তার মাঝে মাঝে উকি দিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়।খেয়াল করলাম ঘোড়াগুলো বৌদ্ধভিক্ষুর কথামতই একদম কিনারা বরাবর ই হাঁটে। এর মধ্যে একটা ছোটখাট কান্ড ঘটে গেল। উঠতে উঠতে গরম বোধ করেই হয়তো শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছিলাম। খোলা চামড়া পেয়েই একটা মৌমাছি ভীষন রকম এক হুল ফুটিয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরেই আশেপাশে মৌমাছির আনাগোনা। তেমন পাত্তা অবশ্য দিচ্ছিলাম না। কামড় খেয়ে হুল ফুটে আছে কীনা পরীক্ষা করে আবার হাটা শুরু করতে হল। সব কিছুর বিরাম আছে। হাঁটার বিরাম নেই। এর মধ্যে পেয়ে গেলাম একটা ঝরণা। সেখানে বৌদ্ধমুর্তি আছে ছোট ছোট। আছে ইচ্ছানুড়ি। ইচ্ছাপূরণের আশায় মানুষ রেখে গেছে অসাধারণ দেখতে কিছু পাথর ঝরণার ধারে। ঝরণার ধারা খুব দুর্বল। তবে জীবনের ছাপ দেখলে পাহাড়ি রাস্তায় কেন যেন অসম্ভব আশার সঞ্চার হয়। জীবনের ছাপ অবশ্য বাকি রাস্তায় ও আছে। আছে মৃত্যুকে মনে রাখার পাথেয় ও। ভুটানিরা দুই ধরনের পতাকা ওড়ায়। এর মাঝে একটা রঙ্গিন কিছু পতাকার সমষ্টি যেটা গোটা হিমালয় এলাকায়
wish flag হিসাবে বিখ্যাত। বৌদ্ধ শ্লোক লিখা থাকে প্রতিটি পতাকাজুড়ে। এগুলো জীবন আর জীবনের পথে সকল ইচ্ছাপূরণের প্রার্থনাকে নির্দেশ করে। এর সাথে আছে প্রায় একই রকম দেখতে সাদা পতাকার সমষ্টি। এগুলো টানানো হয় দুটি আলাদা ঢং এ। মালার মত টানালে এটি মৃতের স্মৃতিকে স্মরণ করতে পবিত্র স্থানে টানানো স্তুতি। আর পতাকার মত ১০৮ টি একবারে টানালে তা সদ্য মৃতের মৃত্যুর ঘোষনা ও তার সমাধির প্রতি সম্মান।

সিয়ান আর সাদিয়ার সাথে আবার দেখা হবার পরেও বাকি রইল প্রায় অর্ধেক রাস্তা। ততক্ষণে ক্লান্তি বেশ ভালভাবেই পেয়ে বসেছে। সাদিয়ার যতটুকু শক্তি ছিল সেটা দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে কখনো উৎসাহ দিয়ে আমাদের প্রায় চুড়া পর্যন্ত চলল সে। এক সময় দেখলাম আমাদের কিছু সহযাত্রী চুড়া থেকে নেমে আসছে। ওরা জানাল আর মিনিট ২০ এর রাস্তা। এই ২০ মিনিট কেটে গেল একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। সেটা আরো ঘনীভূত হল যখন পাইন গাছের সারি চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে টাইগার্স নেস্ট সত্যিকারেই উঁকি দিল চোখের সামনে। ইন্টারনেট এ টাইগার্স নেস্ট লিখে অনুসন্ধান করে এই যাত্রার শুরু। গুগল এর অনুসন্ধান বলবে কয়েক লক্ষ প্রাসঙ্গিক ছবি আছে এই স্থাপনার। কয়েক হাজার ছবি আছে এই একই ফ্রেম এর। বিভিন্ন ঋতুতে। বিভিন্ন ক্যামেরায়। কিন্তু তার পরও “চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন” বলে যে ব্যাপারটা আছে সেটার সাথে আসলে কোন ক্যামেরায় বা ডিজিটাল স্ক্রীণ এ দেখা ছবির কোন ধরনের তুলনা হয় না। সাদা দেয়াল আর লাল ভুটানি ঐতিহ্যবাহী চাল এর স্থাপনাটির সোনালি চুড়ায় রোদের ঝিলিক দেখতে সত্যিই এতটা পথ বেয়ে ওঠা সার্থক মনে হয়। এই অনুভূতিটাই সম্ভবত বংশ পরম্পরায় মানুষ বহন করে চলে। দূর্জয়কে জয় করার ইচ্ছা, অদেখা কে দেখার বাসনা আর নীল আকাশের নিচে ছোট এই গ্রহে নিজের জীবনের সার্থকতা গুলো হয়তো সংজ্ঞায়িত হয় এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতে। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রায় ৩০ মিনিট কেটে গেল। মুগ্ধতা কাটে না।

ভবনের ভেতরের বা নেমে যাওয়ার বর্ণনার বদলে বরং শেষ করি আরেকটি ছোট গল্প দিয়ে। যেটা হয়তো পুরোটাই সত্য, হয়তো সত্য আর লোকগাথার মিশেল। ১৬৯২ সালের এই মঠটির অবস্থান এত উঁচুতে যে অনেক সময় মেঘ জমাট বাধে এর আশেপাশে। আর সরাসরি পাথরের উপরে তৈরি বলে হিমালয় অঞ্চলের রুদ্র প্রকৃতির সাক্ষী বহুদিন ধরেই এর বাসিন্দারাও। এসব কারণে বজ্রপাত ও বনাঞ্চলের দাবানল জাতীয় কারণে বেশ কয়েকবার আগুন ধরে যাবার ইতিহাস ও রয়েছে এর। স্থানীয়রা দাবী করে যতবার ই কোনভাবে আগুন ধরে গিয়েছে বা হুমকির মুখে পড়েছে পারো টাক্সাং বিখ্যাত মূর্তিটি আশ্রয় পেয়েছে পাহাড়ের নিখাদ পাথরের নিরাপদ আশ্রয়ে। আগুন ধরলে এটি সরাসরি ঢুকে যায় পাথরের কোন এক খাঁজে এবং প্রতিবারই রয়ে যায় সম্পূর্ণ অক্ষত। সর্বশেষ আগুন এর ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে একটি ঝাড়বাতিতে বৈদ্যুতিক সমস্যা থেকে। একজন ভিক্ষু মারা যান সেবার এবং মঠটি ধ্বংস হয়ে যায়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত
Restoration এর মাধ্যমে ভুটান এর তৎকালীন রাজা জিংমে ওয়াচুং এর তত্ত্বাবধানে একে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।


সব দেখা শেষ করে যখন নেমে আসি পারো ভ্যালিতে তখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাতের দিকে ঘড়ি যাত্রা শুরু করেছে। পাহাড়ে অন্ধকার নেমে যায় আগেভাগেই। সেটাও কোন ধরনের আগাম বার্তা না দিয়েই। আবছাভাবে শেষবার টাইগার্স নেস্ট এর দিকে তাকিয়ে আবারও শিখলাম- বিপুলা ধরায় কত সামান্য জানি আর কত কিছু দেখা এখনো বাকি! 

This feature was published in Natubarta.com @ 27th May 2019
The link of the article is as following:
https://bit.ly/30O5QsP

Comments

Popular posts from this blog

ভারতকল্প ৩.২- ভুতুড়ে স্বাধীনতা (২)

মর্গ থেকে বেড়িয়ে গাড়ির ভেতরে সবাই একটু ঘোরগ্রস্থ। একই নেটওয়ার্কে চারটা মোবাইলের আলাদা জিপিএস আমাদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছে। পিউলির অবশ্য এক্সেলারেটরের পা উঠে যায় নি। গাড়ি চলছেও সেই ঘোরের মধ্যেই। এর মধ্যে জানে পানি আসার মত জিপিএস ঠিকমত লোকেট করে ফেলল সবাইকে। রেডিও সিগনাল ও ফেরত এসেছে। মর্গ এর ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে করতে জায়গামত এসে পৌছে গেলাম আমরা। এই সেই জাপানী ভদ্রলোকের বাগান। দেখে মনে হয় ইঞ্চি ইঞ্চি করে তৈরি করা। অথচ প্রকৃতি থেকেও আলাদা হয়ে যায় নি। আর ওই দূরে ভারত মহাসাগরের কাচের মত নীলাঞ্জনা হীরার মত পানি! এক চিলতে সাগরপাড় দেখা যাচ্ছে। বহু বহু নিচে! সেখানে কষ্টিপাথরের মত শৈবাল থেকে আসা কাল পাথর জমাট বেধে আছে কিছু। এই দেখতেই না এতদূর এত পথ ঘুরে আসা! সাগরপাড়ে নেমে যাওয়ার সেই ভয়াল রাস্তা!  নিচে নামার ব্যাপারটা অবশ্য নিজেই একটা আলাদা জার্নি। আড়াই ফিট চওড়া সিড়ি আছে একটা। তাঁর কোন রেলিং নেই। ঘুরে প্যাচ খেয়ে নেমে গেছে সৈকতে ঠিকই। তবে তাঁর পরতে পরতে আবার ছোট ছোট এডভেঞ্চার! কোথাও পাথর কেটে দরজা তৈরি করে চলে গেছে সিড়ি, তো কোথাও সিড়ির দুইপাশে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছের ছা...

ভারতকল্প-১- রাজধানী এক্সপ্রেসঃ নিজামউদ্দিনের শহর!

“রাস্তা থামায় দিল, রাস্তা থামায় দিল আউলিয়া... এল দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া এলো...” চন্ডিগড়ের রাস্তা থেকে দিল্লীর বুকে যখন পা রেখেছি তখন আড়াইটার ঘর পার হয়ে মিনিট এর কাঁটা রাত তিনটার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বাসে চলতে থাকা বাংলা গান এর লাইনগুলো মাথার মধ্যে কেন বেজে চলেছে তার কারণ ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মানসিকভাবে একটু বিরক্ত লাগছে কারন এই দুই লাইনের পরের দুই লাইন ঘুমে জড়সড় চোখ নিয়ে মনে আসতে চাইছে না । কেমন একটা ঘোরলাগা অবস্থা। দিল্লীর পাহাড়গঞ্জ এর আরাকাশান রোড এর হোটেলগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুমায় না তাঁদের গায়ে লেগে থাকা নিয়ন বাতিগুলো। ঘোরলাগা- মন মানসিকতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সেগুলোর চোখে পীড়া দেয়া লাল, নীল সবুজ রঙ। আধাঘন্টার মধ্যে কীভাবে হোটেল এ ৪৪ জন মানুষের চেক ইন, লাগেজ রুমে রুমে পৌছে দেয়া হয়ে গেল টের ও পেলাম না। রুম শেয়ার এর চার্ট আগে থেকেই করা থাকায় কিছুক্ষণ পরেই মাঘ মাসের ত্রাহি ত্রাহি শীতের মধ্যে কম্বলের আরাম এ তলিয়ে গেলাম। আগামীকাল দিল্লী অভিযানে বের হওয়া হবে হয়তো। সকালে উঠে একটা প্ল্যান করতে হবে। অনেক নাকি দেখার জায়গা। এসব বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনাতে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ...

ভারতকল্প ৩.১- ভুতুড়ে স্বাধীনতা!

চন্ডীগড় শহরে স্থাপত্য দেখার ব্যাপারটা প্রায় কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনের ছকের মধ্যে আরেক কর্তব্য ছিল সেখানকার আর্কিটেকচার স্কুল ঘুরে দেখা। এই দেখার ফাকে একজন শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন- “এই যে ৪০-৪২ দিনের ভারত দেখে বেড়ানোর বিশাল আয়োজন, এর মধ্যে কোন শহরে কতদিন বরাদ্দ?” ৪০ দিনের বাধা ছকে গোয়া’র জন্য বরাদ্দ পাঁচদিন শুনেই মুখ টিপে হেসেছিলেন অনেকে। গোয়া যেন ভারত মহাসাগরের তীরে স্বাধীনতার ডাক (ছবিঃ সেহরান পারভেজ সিয়ান) আমরা ভারতবর্ষে প্রথম ঘুরতে আসা স্থাপত্য ব্যাচ নই। এই ঐতিহ্য ঠিক কতদিনের পুরাতন তা নিয়ে বেশ একটা ধোয়াশা আছে। তবে বছরের হিসাবে ৩০ এর কম তো নয় ই। এমনকি আমাদের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক ও তার ভারতভ্রমণ এর রেফারেন্স টানেন ঐতিহাসিক স্থাপত্য পড়াতে। গোয়া শহর নিয়ে শুধু চন্ডীগড়ের শিক্ষকেরা নন শুধু আমাদের নিজেদের মধ্যেও বাড়তি উত্তেজনা স্পষ্ট। গোয়া হচ্ছে- স্বাধীনতার নগর! মুম্বাই এর মত কসমোপলিটান নয়, কক্সবাজারের মত বিশ্বের বৃহত্তম সৈকত ও নয়, গোয়া শহর এর স্বাধীনতা একটা সাগরকণ্যা ছোট শহরে দাঁড়িয়ে সাগরপাড়ের জীবনের সর্বোচ্চ স্বাধীনতার হাতছানি! কী না কী হবে সামনে! কত কত গল্প শুনে যাচ্ছি, তা...